টেলিভিশন: শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার, ভবিষ্যৎ কী?
প্রথম পাতা » ফিচার » টেলিভিশন: শতাব্দীর বিস্ময়কর আবিষ্কার, ভবিষ্যৎ কী?মানুষের আধুনিক জীবন যাপনে টেলিভিশন অবিচ্ছেদ্য। ল্যাপটপ কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের আগ্রাসনেও এতটুকুও ভাটা পড়েনি যন্ত্রটির চাহিদায়। আবিষ্কারের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিস্ময়কর যন্ত্রটির ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে।
সাদা-কালো ছবির দিনগুলো থেকে হালের লাইভ স্ট্রিমিংয়ের যুগ পর্যন্ত টেলিভিশন একদিকে যেমন সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে, অন্যদিকে সেসব পরিবর্তন পর্দার মধ্যদিয়ে মানুষের সামনে তুলেও ধরেছে।
টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় ক্যাথোড রে টিউব তথা সিআরটি সংস্করণের মাধ্যমে। এরপর বাজারে আসে রঙিন সিআরটি টিভি। পরবর্তী সময়ে বড় বাক্সের মতো সেসব টিভির পরিবর্তে আসে লাইট এমিটিং ডায়োড-এলইডি টিভি।
খুব দ্রুতই সে সংস্করণেরও জায়গা নেয় লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লে বা এলসিডি টিভি। এখন সে জায়গা দখল করছে স্মার্টটিভির নানান সংস্করণ। এরই মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের স্মার্ট টিভিগুলো।
জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে টেলিভিশন। তথ্যের আদান-প্রদান ও সম্প্রচার এবং বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলেছে এটি। যার স্বীকৃতি দিতেই প্রতিবছরের ২১ নভেম্বর উদযাপিত হয় বিশ্ব টেলিভিশন দিবস।
১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ দিবসটির উদযাপনে সূচনা করে। যার লক্ষ্য গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের ভূমিকা এবং শিক্ষা, বিনোদন ও মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের একটি উন্নত মাধ্যম হিসেবে এর নানা ইতিবাচক দিক আলোকপাত করা।
তথ্য ও প্রযুক্তি তথা ডিজিটাল অগ্রগতির এই যুগে বিশ্ব টেলিভিশন দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের আজও সমান প্রভাব রয়েছে। যা পুরো বিশ্বকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। জ্ঞানের প্রসার ঘটায় ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান দূর করে।
টেলিভিশনের রূপান্তর বা পরিবর্তনের ইতিহাস আমাদের সামনে উদ্ভাবন, সাংস্কৃতিক প্রভাব ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির একটি আকর্ষণীয় যাত্রা প্রতিফলিত করে। সাদা-কালো ছবির দিনগুলো থেকে শুরু করে বর্তমানে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের যুগ পর্যন্ত টেলিভিশন বিশ্বব্যাপী দর্শকদের পরিবর্তিত রুচি, চাহিদা ও পছন্দগুলো পূরণ করে আসছে।
টেলিভিশনের আবির্ভাব (১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশক)
টেলিভিশনের ধারণা প্রথম মানুষের মাথায় আসে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। তবে ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে এসে একটা কার্যকর টেলিভিশন ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়। ১৯২৭ সালে মার্কিন উদ্ভাবক ফিলো টেলর ফার্নসওয়ার্থ প্রথম পূর্ণ বৈদ্যুতিক টেলিভিশন ব্যবস্থা তৈরি করেন।
এরপর রুশ বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী আইজাক শোয়েনবার্গের কৃতিত্বে ১৯৩৬ সালে প্রথম টিভি সম্প্রচার শুরু করে বিবিসি। যার মধ্যদিয়ে টেলিভিশন প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের ভূমিকায় উঠে আসে।
টেলিভিশনের স্বর্ণযুগ (১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশক)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এর পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এজন্য এ সময়টাকে ‘টেলিভিশনের স্বর্ণযুগ’ বলা হয়। ১৯৪০-এর দশকেই যন্ত্রটি পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
১৯৫০-এর দশকে নাটক, সিনেমা ও নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার হতে থাকে। ‘আই লাভ লুসি’ ও ‘দ্য টুয়াইলাইট জোন’র মতো অনুষ্ঠানগুলো বহু দর্শকের মন জয় করে। যার মাধ্যমে টেলিভিশন হয়ে ওঠে সংস্কৃতি চর্চা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের শক্তিশালী মাধ্যম।
রঙিন টিভি ও রিমোট কন্ট্রোল (১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশক)
আগেই বলা হয়েছে, টিভির যাত্রা শুরু হয় সিআরটি (ক্যাথোড রে টিউব) সংস্করণের মাধ্যমে। ১৯৬০-এর দশকে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত উন্নতি ঘটে। বাজারে আসে রঙিন টেলিভিশন। যা আস্তে আস্তে পুরনো সাদা-কালো টিভির স্থান দখল করে।
রঙিন টিভিতে নতুন অভিজ্ঞতা নেয়ার সুযোগ হয় দর্শকদের। একই সময়ে আসে রিমোট কন্টোল যন্ত্রও। যার মাধ্যমে ভলিউম ঘোরানো ছাড়াই শুধুমাত্র বোতাম টিপে পছন্দ মাফিক চ্যানেল দেখার সুযোগ পায় দর্শকরা।
ক্যাবল টিভি ও স্যাটেলাইট সম্প্রচার (১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশক)
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে ক্যাবল টেলিভিশনের প্রসার ঘটে। যার মাধ্যমে মানুষের সামনে আসে পছন্দ ও আগ্রহ অনুযায়ী চ্যানেল দেখার অবারিত সুযোগ। এরপর শুরু হয় স্যাটেলাইট টিভির সম্প্রচার। এই সময়েই মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন ও এমটিভির মতো চ্যানেলগুলো পরিচিত হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল টেলিভিশন ও এইচডির যুগ
এরপর শুরু হয় নতুন শতাব্দী। বাজারে আসল ডিজিটাল টেলিভিশন। দর্শক দেখল আরও স্পষ্ট ছবি। শুনল আরও ভাল সাউন্ড। এ সময় জনপ্রিয়তা পেল হাই ডেফিনেশন তথা এইচডি টেলিভিশন। যার মধ্যদিয়ে আরও আকর্ষণীয় ও বিস্তারিতভাবে ছবি দেখা যায়। হাই ডেফিনেশনের পর আসে ফুল-এইচডি টিভি। এইচডি টিভি রেজল্যুশন সর্বনিম্ন ৭২০ পিক্সেল। আর ফুলএইচডি হবে ১০৮০ পিক্সেলের।
লাইভ স্ট্রিমিংয়ের উত্থান (২০১০ থেকে বর্তমান)
২০১০-এর পর টেলিভিশনে আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটল। শুরু হলো লাইভ স্ট্রিমিং। নেটফ্লিক্স, হুলু ও আমাজন প্রাইম ভিডিও’র মতো প্লাটফর্মগুলো এরই মধ্যে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেখানে দর্শক তার পছন্দ মাফিক কনটেন্ট বা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পায়।
স্মার্ট টিভি ও ফোরকে প্রযুক্তি (২০১০ থেকে বর্তমান)
লাইভ স্ট্রিমিংয়ের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে স্মার্ট টিভির চল। স্মার্ট টিভি বলতে বোঝায়, যে টেলিভিশন দিয়ে ইন্টারনেট চালানোর সুবিধা এবং এর মাধ্যমে বর্তমান সময়ের স্মার্ট ডিভাইসের সুবিধা পাওয়া যায়। এতে ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের সুযোগ থাকে। স্কাইপে, টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
স্মার্ট টিভিতে ওয়াই-ফাই বা ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সুবিধা থাকে। স্মার্ট টিভির রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্য বা ফিচার। স্মার্ট টিভিতে থাকে অনেকগুলো ইউএসবি পোর্ট, যেগুলো এক্সটার্নাল হার্ডড্রাইভ বা পেনড্রাইভ সমর্থন করে। স্মার্ট টিভিতে সাধারণত তিনটি এইচডিএমআই পোর্ট থাকে। নেট ব্রাউজিং, অ্যাপস ইনস্টল, স্ক্রিন শেয়ারিং ইত্যাদি সুবিধার পাশাপাশি জনপ্রিয় কিছু অ্যাপও বিল্ট-ইন থাকে স্মার্ট টিভিতে।
স্মার্ট টিভির সঙ্গে সঙ্গে বাজারে দেখা যায ফোরকে প্রযুক্তি। ফোরকে প্রযুক্তি হচ্ছে বর্তমানের সর্বোচ্চ পিক্সেল রেজুলেশন। আধুনিক ফুল এইচডি ছবিতে যে পরিমাণ পিক্সেলের রেজুলেশন রয়েছে, তার চারগুণ বেশি হচ্ছে ফোরকে। ফোরকে প্রযুক্তিকে ইউএইচডি (আল্ট্রা এইচডি) প্রযুক্তি হিসেবেও পরিচিত অভিহিত করা হয়ে থাকে।
টিভির ভবিষ্যৎ কি হুমকির মুখে?
টেলিভিশনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি প্রতিনিয়তই একটা রূপান্তরের মধ্যদিয়ে সামনে এগিয়েছে। যা এখনও সমানভাবে বাস্তব ও সত্য। তাই বলা যায়, টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ হুমকি নয়, আগামী দিনগুলোতেও নানা পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এটি টিকে থাকবে।
তবে এ কথা সত্য যে টেলিভিশনের প্রথাগত এক রৈখিক মডেল সাম্প্রতিক লাইভ স্ট্রিমিং পরিষেবার মাধ্যমে একটা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। দর্শকের রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে।
সেক্ষেত্রে টিভির পুরনো ধারণা হ্রাস পেলেও পেতে পারে। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে এর অভিযোজনের ফলে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও নানা ধরনের কনটেন্ট তৈরির সুযোগ আরও অবারিত হবে।
এই মুহূর্তে পরিসংখ্যান হয়তো ল্যাপটপ ও মোবাইলের জনপ্রিয়তার কথাই বলবে। কিন্তু পাশাপাশি একথাও সত্য যে কিছু ক্ষেত্রে টেলিভিশন এখনও দর্শকদের প্রথম পছন্দ। যেমন পারিবারিক অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে বা ওটিটি শো বা ক্রিকে বা ফুটবল ম্যাচ দেখার ক্ষেত্রে টিভিই প্রধান উপায়।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ভবিষ্যৎ কেমন?
প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে নতুন নতুন উদ্ভাবনের সমন্বয়, ভোক্তাদের আচরণগত পরিবর্তন ও কনটেন্ট সরবরাহের মডেলগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথাগত টেলিভিশনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। এর পেছনে কয়েকটি প্রভাবক কাজ করছে:
অন-ডিমান্ড কন্টেন্ট বা চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট সরবরাহ: লাইভ স্ট্রিমিং পরিষেবার মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট সরবরাহ করছে। যার ফলে দর্শক যা দেখতে চায়, যখন চায় তা দেখার সুযোগ পাচ্ছে। এই সুযোগ প্রথাগত টিভি সময়সূচীর বিপরীতে গিয়ে দর্শকদের টানতে সক্ষম হচ্ছে।
অরিজিনাল কনটেন্ট নির্মাণ: নেটফ্লিক্স, হুলু ও আমাজন প্রাইম ভিডিও’র মতো স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলো হাই-কোয়ালিটি তথা উন্নতমানের অরিজিনাল কনটেন্ট তৈরিতে নজর দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে।
তারা দর্শকদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটিকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। যেমন দর্শকরা বিশেষ কোনো শো ও মুভি বা সিনেমাকে বেশি দেখে থাকে। আর প্লাটফর্মগুলো তাদের সামনে উন্নতমানের কনটেন্ট পরিবেশন করছে।
মোবাইল ফোনে দেখার সুযোগ: বর্তমানে প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন। একই সঙ্গে এই ধরনের সহজে বহনযোগ্য ডিভাইস দেখা যায়। ফলে দর্শক যেখানে খুশি সেখানে বসেই তাদের পছন্দের কনটেন্ট দেখতে পারে। তাছাড়া টিভি যেখানে ঘরের কোণে, মোবাইল বা স্মার্টফোন সেখানে সর্বত্রই বহনযোগ্য। আর এ বিষয়টিই প্রথাগত টিভির চেয়ে ডিজিটাল প্লাটফর্মকে এগিয়ে রাখছে।