আজ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির শপথ

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » আজ নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির শপথ


ফাইল ছবি
 বাংলার-পৃথিবীঃ    নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সামনে পাঁচটি বড় চ্যালেঞ্জ। এগুলো হলো রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে বিচার বিভাগকে পরিচালনা, আদালত অঙ্গনের দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ, মামলাজট নিরসন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করা এবং আদালত ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা বজায় রেখে প্রধান বিচারপতিকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠাই তাঁর লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ কাজে তিনি সফল হলে বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরবে।

সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন দেশের জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞরা। গত ১২ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ওবায়দুল হাসানকে নিয়োগ দেন। তিনি আজ মঙ্গলবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ২০২৬ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি অবসরে যাবেন।
আইনজ্ঞদের মতে, প্রধান বিচারপতিকে এখনই কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করে বিচার বিভাগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। রাজনৈতিক বিষয়সহ কোনো ইস্যুতে বিচারাঙ্গন যাতে অস্থিতিশীল না হয়, সেদিকেও তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে। বিচার বিভাগের স্বার্থে বার ও বেঞ্চের মধ্যে মতভেদ আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করা প্রয়োজন।

নয়া প্রধান বিচারপতির জন্য চারটি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক। তিনি সমকালকে বলেন, মামলাজটের কথা প্রথমেই আসে। অনেক দেশেই এমন মামলাজট হয়েছে এবং তারা সমাধানও করেছে। সমাধানের উপায়গুলো মোটেও জটিল নয়। এখানে দরকার প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ এবং সরকারের প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ। দ্বিতীয় সমস্যা হলো ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে একটা রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। ফলে পুলিশ এবং ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার ওপরে জনগণের আস্থা বহুলাংশে কমে গেছে। এভাবে আরও কিছুদিন চলতে থাকলে সমাজে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা তৈরি হতে পারে। তখন সমাধান অনেক দুরূহ হবে। তাই এ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অপরাধের ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো ধরনের দায়দায়িত্ব নেই। এটা অমানবিক। যেমন কোনো পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি খুন হলে বা কারও ব্যবসা-বাণিজ্য লুট করে নিয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের সহায়তা প্রসারিত করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি উদ্যোগ নিলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা। চতুর্থত, দুর্নীতি দমন করা। আদালত-সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগগুলো গ্রহণ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর বিষয়ে প্রধান বিচারপতির পদক্ষেপ প্রয়োজন।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘মামলাজট বিচার বিভাগের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে প্রধান বিচারপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মতামত গ্রহণ করতে পারেন। তবে আমার মতে, মামলাজট নিরসনে আদালতে যত দ্রুত সম্ভব বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। উদ্যোগটি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকেই নেওয়া উচিত। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে আইন সংশোধনের পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’ তবে বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার বিষয়টি প্রধান বিচারপতির জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন সাবেক এই আইনমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগ রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে গেলে জনগণের আস্থা কমবে। ইদানীং নানা ইস্যুতে বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে, এটি কারও কাম্য নয়। বিচার বিভাগকে এসব বিতর্কের মধ্যে জড়ানো যাবে না। আইনজীবীদেরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা রাজনীতি করতে পারেন, কিন্তু সেটা যেন বিচার বিভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। আর আদালত অঙ্গনে দুর্নীতির ব্যাপারেও প্রধান বিচারপতিকে সোচ্চার হতে হবে। জনগণের আস্থা হারালে বিচারক-আইনজীবীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এটি মনে রাখা দরকার।’

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, প্রধান বিচারপতির কাছে নানা প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সেই প্রত্যাশাগুলোর প্রতিফলন ঘটেনি। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির কাছেও অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। বিভিন্ন কারণে সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, এগুলো পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রধান বিচারপতিকে চারটি বিষয়ে নজর দিতে হবে। তাঁর মতে, আইনের শাসনের দুর্বলতা দূর করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ; আদালত অবমানার বিষয়গুলোতে জোরালোভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ, বিচার বিভাগের দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মামলাজট কমানোর জন্য অধিক সংখ্যক বিচারক নিয়োগই প্রধান বিচারপতি লক্ষ্য হওয়া উচিত। এসব ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জোরালো প্রস্তাব পাঠাতে হবে। এগুলো পূরণ না হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘গত কয়েক বছরে দেশের আদালতগুলোতে প্রায় এক লাখ হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধান বিচারপতির উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি কীভাবে বিষয়টি দেখছেন এবং আদালতগুলোকে কী পদক্ষেপ নিতে বলেন– সেটাই দেখার বিষয়। এটি প্রধান বিচারপতির জন্য চ্যালেঞ্জ।’ তিনি আরও বলেন, আদালত অঙ্গনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে গেছে। এ ব্যাপারেও প্রধান বিচারপতির কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিতে এর কোনো বিকল্প নেই। বিচারকরা যেন স্বাধীনভাবে রায় ও আদেশ দিতে পারেন। তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের অভিভাবক। তাকেই বিচার বিভাগের সব বিষয়ে দায়দায়িত্ব নিতে হবে।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগই প্রত্যাশা। দেশ থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে হলে বিচার বিভাগ থেকেই সেই আন্দোলন শুরু করতে হবে। আর তা হতে হবে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। কারণ এই দুরারোগ্য ব্যাধির একমাত্র চিকিৎসক হলেন বিচারক ও আইনজীবীরা। এই ব্যাধি উৎখাত ও নিমূর্লই হোক লক্ষ্য।’ জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘মামলাজট কমানো, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, বিচারিক আদালতের কর্মঘণ্টার সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি কমাতে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর এগুলো সমাধানের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে সচিবালয় গঠন করাও জরুরি। প্রধান বিচারপতি এসব ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করছি।’