৮৭ টাকার স্যালাইন মিলছে না ৩০০ টাকার নিচে

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ৮৭ টাকার স্যালাইন মিলছে না ৩০০ টাকার নিচে


৮৭ টাকার স্যালাইন মিলছে না ৩০০ টাকার নিচে
 বাংলার-পৃথিবীঃ   চট্টগ্রামে  প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও। স্বজনকে হারিয়ে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হচ্ছে অনেক পরিবার। তবে রোগী বৃদ্ধি অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য যেন ‘শাপে বর’ হয়ে এসেছে। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ডেক্সট্রোজ নরমাল স্যালাইন (ডিএনএস) নিয়ে চট্টগ্রামে চলছে অরাজকতা। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেড়ে যাওয়ায় এর চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। আর এটিকে পুঁজি করে অন্যরকম এক খেলায় মেতে উঠেছে অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীরা।

বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। মাত্র ৮৭ টাকার একটি স্যালাইন মিলছে না ৩০০ টাকার নিচে। এদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে ঠকছেন রোগী ও তাদের স্বজন। কিন্তু প্রশাসন ও বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান থাকার পরও প্রতিটি স্যালাইনে কয়েক গুণ বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্যালাইন নিয়ে ভয়াবহ কারসাজিতে জড়িত প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান। বাড়তি দামে স্যালাইন বিক্রি করে প্রতিনিয়ত অসহায় রোগী ও তাদের স্বজনের ‘পকেট কাটছে’ তারা। এর নেপথ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের বড় তিন বাজারের কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের বৃহৎ ওষুধের মোকাম হাজারী গলি, চমেক হাসপাতাল ও বহদ্দারহাট হক মার্কেটের অসাধু ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করছে স্যালাইনের বাজার। এদের সঙ্গে জড়িত হাসপাতালের চারপাশের ছোট-বড় কিছু ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি। কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে সাহান মেডিকো, ইমন মেডিকেল হল, পপুলার মেডিসিন কর্নার, বেঙ্গল, সবুজ ও চট্টলা ফার্মেসি, মেসার্স এনএম ফার্মা, এস মেডিকো, সবুজ ফার্মাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উল্লেখযোগ্য। নানা কৌশলে তারা কোম্পানি থেকে বাড়তি স্যালাইন সংগ্রহ করে তা গোপনে মজুত করছে। এ কারণে এক ফার্মেসি থেকে অন্য ফার্মেসি হন্যে হয়ে ঘুরেও প্রয়োজনীয় স্যালাইন মিলছে না। পাওয়া গেলেও গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দাম। এদের অনেকের ব্যাপারে এরই মধ্যে কারসাজির অহরহ প্রমাণও পেয়েছে খোদ প্রশাসন। জড়িতদের চিহ্নিত করতে মাঠ পর্যায়ে যাবতীয় কাজ চলমান থাকার কথা বলছেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। চট্টগ্রামে প্রতিদিন গড়ে ১৫০ জনের ওপরে নতুন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ছুঁইছুঁই। মৃত্যু হয়েছে রেকর্ড ৭১ জনের।

পরিচয় গোপন রেখে চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেটের সামনে থাকা সাহান মেডিকো, মেসার্স ইমন মেডিকেল, জয়নাব মেডিকেল হল, সেবা মেডিকেলসহ বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে স্যালাইন নেই বলে জানানো হয়। খুব জরুরি বললে ইমন মেডিকেলের এক বিক্রয় ব্যবস্থাপক বলেন, ‘দাম পড়বে ৩৫০ টাকা।’

ডেঙ্গু আক্রান্ত চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাসিন্দা ৩৮ বছরের মো. মোরশেদ আলমের প্লাটিলেট মাত্র ৬০ হাজারে নেমে যাওয়ায় দ্রুত স্যালাইন দেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।

তবে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ডসহ আশপাশে থাকা প্রায় সব ফার্মেসিতে গিয়েও একটি স্যালাইন পাননি তাঁর স্বজন। যে কারণে অনেক দূরের পথ পাড়ি দিয়ে তারা আসেন নগরের বহদ্দারহাটের হক মার্কেটে। সেখানকার কোনো ফার্মেসিতেও পাওয়া যায়নি স্যালাইন। পরে মোরশেদের স্ত্রী তন্নি ইসলাম পরিচিত একজনের মাধ্যমে অনেক কষ্টে ৩০০ টাকার বিনিময়ে একটি স্যালাইন পান। এভাবে স্যালাইন কিনতে গিয়ে এমন হয়রানি ও নৈরাজ্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনেককে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের চারপাশে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশত বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের একটি বড় অংশই প্রতিদিন ভর্তি হয় এসব হাসপাতালে। এ ছাড়া নগরের আন্দরকিল্লার জেনারেল হাসপাতাল, আগ্রাবাদের মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল, বেসরকারি ম্যাক্স, পার্কভিউ, ন্যাশনাল, মেডিকেল সেন্টার, মেট্রোপলিটন, সিএসসিআর, ডেল্টা, একুশেসহ কয়েকটি হাসপাতালে বেশির ভাগ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এখানকার বাড়তি রোগীকে টার্গেট করে স্যালাইন নিয়ে কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছে এসব হাসপাতালের চারপাশে গড়ে ওঠা কিছু ফার্মেসি। যারা বিপুল পরিমাণ স্যালাইন গোপনে নিজেদের গোডাউনে মজুত করে রাখছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম কয়েক দফায় বাড়ানোর পর কয়েক ভাগে সেসব স্যালাইন বাজারে ছাড়ছে। এভাবে প্রতিটি স্যালাইন বিক্রি বাবদ কয়েক গুণ বেশি বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে অসাধু চক্রটি।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকায় আমরা চিন্তিত। অথচ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী কারসাজি করছে। স্যালাইন নিয়ে কারসাজির সঙ্গে চট্টগ্রামের বড় তিন বাজারের কিছু ব্যবসায়ী জড়িত। এর বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছি আমরা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সতর্কও করেছি।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ডেঙ্গু প্রকোপের এই সময়ে ওষুধ ব্যবসায়ীরা স্যালাইনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়াচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রশাসনকে জানিয়েছি।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে কিছু প্রতিষ্ঠান কারসাজিতে জড়িয়ে পড়ছে। মাত্র ৮৭ টাকার স্যালাইন ৩০০ টাকার ওপরে বিক্রির প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছি। অসাধু ব্যবসায়ীদের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রতীক দত্ত বলেন, রোগী সেজে বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে যান আমাদের কয়েকজন। তবে কোনো দোকানেই স্যালাইন পাননি তারা। অথচ এর কিছুক্ষণ পর সেসব দোকানে অভিযান চালালে প্রতিটি ফার্মেসিতেই পর্যাপ্ত স্যালাইনের মজুতের প্রমাণ পেয়েছি।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এসএম সুলতানুল আরেফিন বলেন, পাঁচটি ওষুধ কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা আমাদের জানিয়েছে, তারা পর্যাপ্ত স্যালাইন উৎপাদন করছে এবং চাহিদামতো সরবরাহও করছে। তার পরও কারসাজি করে কয়েক গুণ বেশি টাকা আদায় করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, চট্টগ্রামে স্যালাইনের দাম নিয়ে চলছে ভয়াবহ নৈরাজ্য। অথচ প্রশাসন সামান্য টাকা জরিমানা করেই দায়িত্ব শেষ করছে।