কার্যকর নিয়ে সংশয় সরকার দাম বেঁধে দিলেও

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » কার্যকর নিয়ে সংশয় সরকার দাম বেঁধে দিলেও


ফাইল ছবি
বাংলার-পৃথিবীঃ       নিত্যপণ্যের বাজার নাগালের বাইরে চলে গেলে বাধ্য হয়ে দাম বেঁধে দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তর। তবে বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করা নিয়ে সব সময় প্রশ্ন ওঠে। দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় প্রথমবারের মতো ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নির্ধারিত দরে বিক্রি না হলে আমদানির হুমকিও দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। গতকাল বৃহস্পতিবার এই তিন পণ্যের দর বেঁধে দেওয়ার পরও বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিক্রেতারা দাম রাখছেন যে যার মতো।

এর আগে যতবারই ভোজ্যতেল ও চিনির দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিল, খুচরা থেকে সরবরাহকারী কাউকেই তা মানতে দেখা যায়নি। ফলে ভোক্তারা দাম কমার সুফল পান না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক। তবে মুখে মুখে দাম বেঁধে দিলেই হবে না। এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য সরবরাহ না বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করলে তা কার্যকর হবে না। পাশাপাশি কৃত্রিম সংকট হচ্ছে কিনা, তা তদারকি করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মাস দুয়েক ধরে ডিম, আলু, পেঁয়াজসহ বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। গতকালও ঢাকার খুচরা বাজারে ডিমের ডজন ১৪৫ থেকে ১৫৫, আলুর কেজি ৪৮ থেকে ৫০ এবং দেশি পেঁয়াজের কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মন্ত্রণালয় গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করে আলুর কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৬৪ থেকে ৬৫ আর ডিম প্রতি পিস ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়।

পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সর্বশেষ গত আগস্টে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে, যা সবচেয়ে বেশি চাপে ফেলছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। এ পরিস্থিতিতে গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভায় তিন কৃষিপণ্যের দর বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিষয়টি পরে প্রেস ব্রিফিং করে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

গত বুধবার নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক সভা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এসব পণ্যের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। এতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে আলুর কোল্ডস্টোরেজ ও পাইকারি পর্যায়ে দাম হবে ২৬ থেকে ২৭ টাকা। পেঁয়াজের পাইকারি দর হবে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা। গতকাল থেকেই পণ্য তিনটির নির্ধারিত দাম কার্যকর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত দামে এসব পণ্য বিক্রয় হচ্ছে কিনা, তা তদারকির জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন কাজ করবে বলেও জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। এসব পণ্যের দাম বাজারে কমে এলে সরকার আরও কমাবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

টিপু মুনশি বলেন, উৎপাদক, পাইকারি এবং খুচরা পর্যায়ের খরচ ও মুনাফা বিবেচনায় নিয়েই এসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে কারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কেউ বেশি মুনাফা লাভের জন্য অবৈধভাবে পণ্য মজুত রাখলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে ডিম বিক্রি হলে আমদানির অনুমতি দেওয়া হবে বলেও জানান মন্ত্রী। এরই মধ্যে ডিম আমদানির জন্য মন্ত্রণালয়ে বেশ কিছু আবেদন জমা পড়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে এসব পণ্যের যৌক্তিক দর নির্ধারণ-সংক্রান্ত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১১ টাকা ৫১ পয়সা। উৎপাদন পর্যায়ে বিপণন ও যৌক্তিক লাভ ২ টাকা ৬৬ পয়সা ধরে এ পর্যায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ টাকা ১৭ পয়সা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এ দামে আলু কিনবেন। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হবে স্থানীয় পরিবহন বাবদ ১ টাকা ৪৫ পয়সা, অন্যান্য বিপণন খরচ ৩ টাকা, কোল্ডস্টোরেজ ভাড়া ৫ টাকা, আড়ত কমিশন দেড় টাকাসহ যৌক্তিক লাভ ১০ শতাংশ হারে ২ টাকা ৫১ পয়সা। সব মিলিয়ে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর দাম দাঁড়াবে ২৭ টাকা ৬৩ পয়সা। এই দামের সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে বিপণন খরচ বাবদ আরও যুক্ত হবে ৩ টাকা ৫৬ পয়সা এবং এ পর্যায়ে যৌক্তিক লাভ ১৫ শতাংশ হারে ৪ টাকা ৬৮ পয়সা। এভাবে ১১ টাকা ৫১ পয়সা উৎপাদন খরচের আলু ভোক্তার হাতে পৌঁছাবে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায়।

পেঁয়াজের ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ৩৩ টাকা ৪ পয়সা। উৎপাদন পর্যায়ে বিপণন সাড়ে ৩ টাকা ও যৌক্তিক লাভ ১৪ শতাংশ হারে ৫ টাকা ১২ পয়সা ধরে এ পর্যায়ে যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১ টাকা ৬৬ পয়সা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এ দামে পেঁয়াজ কিনবেন। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হবে স্থানীয় পরিবহন বাবদ ১ টাকা ৩৩ পয়সা, অন্য বিপণন খরচ ৩ টাকা ২০ পয়সা, আড়ত কমিশন দেড় টাকাসহ যৌক্তির লাভ ১০ শতাংশ হারে ৪ টাকা ৭৭ পয়সা। সব মিলিয়ে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়বে ৫২ টাকা ৪৫ পয়সা।

এ দামের সঙ্গে খুচরা পর্যায়ে বিপণন খরচ বাবদ আরও যুক্ত হবে ৫ টাকা ৫০ পয়সা এবং এ পর্যায়ে যৌক্তিক লাভ ১২ শতাংশ হারে ৬ টাকা ৯৫ পয়সা। এভাবে ৩৩ টাকা উৎপাদন খরচের পেঁয়াজ ভোক্তার হাতে পৌঁছাবে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকায়। এ ছাড়া মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বর্তমানে প্রতি পিস ডিম উৎপাদনে খরচ সাড়ে ১০ টাকা। তাই খুচরা পর্যায়ে ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ টাকা।

গতকালের সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভোক্তা অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার থেকেই বাজারে অভিযান শুরু করবে। এ ছাড়া নির্ধারিত দরে পণ্য বিক্রির জন্য সব জেলা প্রশাসক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হবে। দেশের সর্বত্র ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে এবং আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পর্যাপ্ত আলু হিমাগারে আছে। কোনো হিমাগার মালিক নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি না করলে জেলা বা উপজেলা প্রশাসন তা জব্দ করে নিলামে তুলবে।

তবে দাম বেঁধে দিলে তা কার্যকর হবে কিনা সে বিষয়ে শঙ্কা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, দাম বাড়ার সিদ্ধান্ত হলে তা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়। কমানোর সিদ্ধান্ত হলে তা বাস্তবায়নে কচ্ছপগতি দেখা যায়। এদিকে বারবার বাজার তদারকির কথা বলা হলেও তাতে খুব বেশি উপকার হচ্ছে না। পণ্যের দাম দু-এক দিন কমে আবার বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, বাজার তদারকিতে ডজনখানেক সংস্থা থাকলেও ভোক্তা অধিদপ্তর ছাড়া সরকারের অন্য কোনো সংস্থাকে মাঠে তেমন একটা দেখা যায় না। আবার ভোক্তা অধিদপ্তর নির্দিষ্ট কিছু বড় বাজার ছাড়া পাড়া-মহল্লা কিংবা এলাকাভিত্তিক ছোট বাজারগুলোতে তদারকি করে না।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান  বলেন, পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়ার উদ্যোগটা ভালো। তবে এটি কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা দেখার বিষয়। কারণ, বিভিন্ন সময় মুখে মুখে নানা আইনকানুনের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না।

দাম কার্যকর করতে দুটি পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রথমত, বাজারে পণ্যের জোগান স্বাভাবিক রাখা জরুরি। সেজন্য কোথাও অবৈধ মজুতের কারণে কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে। বাস্তবে সংকট হলে সরকারি উদ্যোগে পণ্যের জোগানের ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

বেসরকারি সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, এ সিদ্ধান্তে ভোক্তাদের উপকার হওয়ার কথা। তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। তাঁর মতে, দাম বাস্তবায়ন করতে হলে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই। তাছাড়া ব্যবসায়ীরা এ দাম বাস্তবায়নে কতটা ভূমিকা রাখবেন, তাও বিবেচনায় নিতে হবে। একই সঙ্গে দেশে কোন পণ্য কী পরিমাণে মজুত রয়েছে, তার নির্ভুল তথ্য দরকার। কারণ, পণ্য সরবরাহে ঘাটতির তথ্য বাজারে ছড়িয়ে পড়লেও দাম বেড়ে যায়।

সেলিম রায়হান বলেন, দেশে পণ্যের জোগানের সঠিক তথ্য না থাকলে সমস্যা হবে। কারণ দেখা যাবে, বাজারে বেঁধে দেওয়া দাম ঠিকই রয়েছে, কিন্তু পণ্য নেই। তখন বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। এ জন্য পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো ও মজুতের নির্ভুল তথ্য সংরক্ষণ জরুরি। দাম কার্যকরে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকেও কাজে লাগাতে হবে।

এদিকে বোতলজাত সয়াবিন ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমিয়ে যথাক্রমে ১৬৯ ও ১৪৯ টাকা এবং পাম তেলের দাম ৪ টাকা কমিয়ে ১২৪ টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, আগামী রোববার থেকে নতুন দাম কার্যকর করা হবে।