বায়ুদূষণের ফলে দেশে গড় আয়ু কমছে
প্রথম পাতা » ফিচার » বায়ুদূষণের ফলে দেশে গড় আয়ু কমছে
বাংলার পৃথিবীঃ বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমছে প্রায় ৬ বছর ৮ মাস। তবে এলাকাভেদে পরিস্থিতি আরও করুণ। যেমন, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা গাজীপুরে মানুষের গড় আয়ু কমছে ৮ বছর ৩ মাস। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স, ২০২৩’ শীর্ষক বৈশ্বিক এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট। গবেষণায় স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ২০২১ সালের বাতাসের গুণমান বিশ্লেষণ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ুর জেলা। বায়ুদূষণের কারণে এই জেলায় বসবাসকারী মানুষের গড় আয়ু কমছে ৮ বছর ৩ মাস। আর সবচেয়ে কম দূষিত যে জেলা, সেই সিলেটেও বাতাসে দূষণ কণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে ৯ দশমিক ৭ গুণ এবং জাতীয় মানের চেয়ে ৩ দশমিক ২ গুণ। বায়ুদূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ুতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এ দুই অঞ্চলে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ মানুষের বসবাস। দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মানুষের আয়ু কমছে গড়ে ৭ বছর ৬ মাস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে সর্বোচ্চ দূষণ কণার মান ৫ মিলিগ্রাম। অথচ, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি তার ১৪ থেকে ১৬ গুণ। সরকার অবশ্য ১৫ মিলিগ্রামকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বাতাসে দূষণকারী গ্যাসীয় কণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৭০ থেকে ৮০ মিলিগ্রাম, যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হৃদরোগের পরই বড় হুমকি হিসেবে বায়ুদূষণকে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এর প্রভাব ধূমপানের চেয়ে মারাত্মক। প্রতিবেদনে বলা হয়, তামাক সেবনের কারণে গড়ে আয়ু কমছে ২ বছর ১ মাস, অপুষ্টির কারণে শিশু ও মায়েদের আয়ু কমছে গড়ে ১ বছর ৮ মাস; আর বায়ুদূষণের কারণে কমছে ৬ বছর ৮ মাস।
বাংলাদেশকে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ বললেও গবেষকরা জানান, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে এখানে বায়ুদূষণ ২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে, যদিও এর কোনো কারণ তারা উল্লেখ করেননি। তবে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সময় লকডাউনের কারণে পরিস্থিতির কিছু অগ্রগতি হয়। ২০২২ সালে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আবার বায়ুদূষণ বাড়তে থাকে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বে বায়ুদূষণ প্রায় ৫৯ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী ভারত। দেশটিতে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর নয়াদিল্লি। সামগ্রিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণ করলে বিভিন্ন দেশে মানুষের গড় আয়ু দুই বছর তিন মাস পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। এর মাধ্যমে বছরে এক কোটি ৭৮ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা পাবে। আর ঢাকায় বায়ুর মান উন্নত করে গড় আয়ু আট বছর এক মাস, চট্টগ্রামে ৬ বছর ৯ মাস এবং পুরো দেশে পাঁচ বছর আট মাস বাড়ানো সম্ভব বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। এই তালিকায় ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘বায়ুদূষণ রোধে সরকারের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবেই দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। দায়িত্বপ্রাপ্তরা দৃশ্যমান ও টেকসই কোনো সমাধান তৈরি করতে পারেননি।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘শীতকালে, অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে যে বায়ুদূষণ হয় তার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হয় ট্রান্সবাউন্ডারি, অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসে। এটি নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন কিছু করার নেই। বাকি যে ৬৫ শতাংশ দূষণ, তার উৎস কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে সরকার।’ এজন্য বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ জারি করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।