লুটপাট কৃষি যান্ত্রিকীকরণে
প্রথম পাতা » অর্থ ও বানিজ্য » লুটপাট কৃষি যান্ত্রিকীকরণে
বাংলার-পৃথিবীঃ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) এক বঁটির দাম ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ২০২০ সালে বেশ আলোড়ন তুলেছিল ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পটি। শুরু থেকে অনিয়মের ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রকল্পটি এখনও হাঁটছে সে পথেই। যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল কৃষক যাতে ফসল উৎপাদন বাড়াতে, সময় বাঁচাতে ও মুনাফা নিশ্চিত করতে পারে। তবে কৃষক নয়, ‘মুনাফা নিশ্চিত’ করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্তারা। কৃষিকে লাভজনক, বাণিজ্যিকীকরণ ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে সরকার জোর দিচ্ছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে, আর কিছু অসাধু কর্মকর্তা মেতেছেন লুটপাটতন্ত্রে। পাঁচ বছরের এই প্রকল্পটির মাঝপথ পেরোতেই রকমারি দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক তদন্তের জন্য নথি পাঠায় কৃষি মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় এ বছর তদন্ত কমিটি করেই হাঁপিয়ে গেছে। তদন্ত প্রতিবেদন আজও দেখেনি আলোর মুখ। এখানেই শেষ নয়, খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত ৩০ জুন প্রকাশিত নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে প্রকল্পে দুর্নীতির ‘আমলনামা’।
অনিয়মের অভিযোগে ক্ষুব্ধ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তারও। গত ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ের এক সভায় প্রকল্প পরিচালকের ওপর এ নিয়ে ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি। প্রকল্প বাস্তবায়নের তিন বছর পার হলেও এখনও জেলাগুলোতে তদারক কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ার বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন সচিব। এর আগে আরেক সভায় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকও উপকারভোগীদের তালিকা চেয়ে প্রকল্প পরিচালককে সতর্ক করেন।
শুধু ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পটিই নয়, এর আগে ২০১০ সালে কৃষকদের আধুনিকায়নের জন্য সরকারের নেওয়া প্রথম উদ্যোগেও লেগে আছে হরিলুটের দাগ। ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন’ ১০ বছরের প্রকল্পটিও ছিল ‘পুকুরচুরি’তে ভরা। উন্নয়ন সহায়তার (ভর্তুকি) মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) কৃষি যান্ত্রিকীকরণে দুটি বড় প্রকল্প হাতে নিলেও বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না।
মাঠ পর্যায় থেকে আসছে একের পর এক অনিয়মের ফিরিস্তি। এ নিয়ে অস্বস্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয়। যন্ত্র যখন যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন কৃষিমন্ত্রী ও সচিব বারবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিচ্ছেন হুঁশিয়ারি। দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে পাওয়ার টিলার, পাওয়ার থ্রেসার, কম্বাইন হারভেস্টার, হ্যান্ড রিপার, ট্রাক্টর, স্প্রেয়ার, গুটি ইউরিয়ার যন্ত্র, রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, সিডার, ফুট পাম্প, মেইজ শেলারসহ এ রকম আরও কিছু আধুনিক যন্ত্র ভর্তুকি দরে কৃষকদের সরবরাহ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও এখনও যন্ত্র দেওয়া হচ্ছে। প্রথম প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দরে ৭৫ হাজার ৮৫০টি যন্ত্র বিক্রি করা হয়েছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় প্রকল্পের আওতায় শেষ তিন বছরে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার যন্ত্র। হাওর ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং অন্য সব এলাকার কৃষকরা ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দরে যন্ত্র কিনতে পেরেছেন বলে কাগজে-কলমে উল্লেখ আছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ভর্তুকির সুবিধায় ভাগ বসাচ্ছেন অসাধু কর্মকর্তা, যন্ত্র সরবরাহকারী কিছু কোম্পানি ও স্থানীয় দালাল। ভর্তুকির যন্ত্রের জন্য ঘুষ, যন্ত্রের দাম বাড়িয়ে কৃষকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায়, ভুয়া উপকারভোগী বানিয়ে পুরো যন্ত্রের টাকা আত্মসাৎ, প্রকৃত কৃষকদের বদলে অন্যকে যন্ত্র দেওয়া, মানহীন যন্ত্র সরবরাহ, যন্ত্র বিতরণে প্রভাবশালীদের প্রভাব, নষ্ট হলে কোম্পানিগুলোর বিক্রয়োত্তর সেবা না দেওয়া, এক যন্ত্র কয়েকবার বিক্রি করে একাধিকবার ভর্তুকি নেওয়াসহ রয়েছে নানা অভিযোগ।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুরু থেকে এ দুটি প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। অনিয়মের প্রমাণ থাকলেও পার পেয়ে গেছেন অভিযুক্তরা। ফলে দেশে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার জনপ্রিয় করার জন্য ভর্তুকি, প্রণোদনা, শুল্ক ছাড়সহ নানা উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। যা আছে আইএমইডি প্রতিবেদনে
‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প নিয়ে আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারিগরি কমিটির নির্দেশনা না মেনে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাব মেরামত দেখিয়ে টাকা খরচ করা হয়েছে। বাজারদর যাচাই না করে উচ্চ দরে যন্ত্র কেনা, নিম্নমানের যন্ত্র সরবরাহ করা হলেও জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ, কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় এবং বার্ষিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ খরচ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটিতে উপকারভোগী শনাক্তকরণে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের অভাব রয়েছে। কৃষক সঠিকভাবে যন্ত্র পাচ্ছেন কিনা, তা তদারকি করা হচ্ছে না। কোম্পানিগুলো বিক্রয়োত্তর সেবা দিচ্ছে না। কম্বাইন হারভেস্টার বারবার নষ্ট হওয়ায় কৃষকের বিনিয়োগ করা টাকা না ওঠার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তালিকাভুক্ত না হওয়া অনেকে ভর্তুকিতে যন্ত্র সুবিধা পাচ্ছে। একই উপকারভোগীর একাধিকবার ভর্তুকিতে যন্ত্র পাওয়ার ঘটনাও রয়েছে।
প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোর অনিয়ম নিয়ে বলা হয়েছে, ভর্তুকির কৃষিযন্ত্র দিতে অনেক কৃষকের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়েছে। যন্ত্র হস্তান্তরের অনুষ্ঠানের পর সরবরাহকারী কোম্পানি যন্ত্রটি তাদের শোরুমে ফেরত নিয়ে অন্য কোনো কৃষকের কাছে বিক্রি ও হস্তান্তর করেছে। নির্বাচিত কৃষক যন্ত্র কিনতে রসিদ মূলে যে টাকা দিয়েছিলেন, তাও সমীক্ষাকালীন পর্যন্ত ফেরত দেওয়া হয়নি।
যেভাবে কৃষক বাছাই
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে যন্ত্র বরাদ্দ পাওয়ার পর তা মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করেন প্রকল্প পরিচালক। ভর্তুকি দরে যন্ত্র কেনার জন্য কৃষকের আবেদনের পর খসড়া তালিকা প্রস্তুত করে উপজেলা বাছাই কমিটি। বাছাই কমিটিতে থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা। চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুতের পর উপকারভোগী কৃষকদের প্রত্যয়নপত্র দেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা। ভর্তুকি বাদে বাকি টাকা দিয়ে প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে কৃষক ডিলারের কাছ থেকে যন্ত্রটি সংগ্রহ করেন।
গোড়ায় গলদ, হয়নি শাস্তি
২০১০ সালের জুলাইয়ে দুই বছরের ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন’ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। এর পর দুই দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুলাইয়ে টানা হয় প্রকল্পের ইতি। সব মিলিয়ে প্রকল্প খরচ দাঁড়ায় ৪৯৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ছিলেন শেখ মো. নাজিম উদ্দিন ও উপপ্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম শেখ। প্রকল্প এলাকায় সমকাল খোঁজ নিয়ে দেখেছে, ২০১৯ সালের আগে বিতরণ করা অনেক যন্ত্রের এখন আর হদিস নেই। কিছু যন্ত্র অকেজো হয়ে গেছে। যন্ত্র সেবাকেন্দ্র নির্মাণের নামে টাকা খরচ হলেও এর খোঁজ মেলেনি। কিশোরগঞ্জ সদরে ১৯টি কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ দেওয়া হলেও কয়েক মাস খুঁজেও তা পাওয়া যায়নি। এমনকি কৃষি কর্মকর্তারাও সেই উপকারভোগীদের খোঁজ দিতে পারেননি। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুল ইসলাম পেয়েছেন কৃষকের ভর্তুকির পাওয়ার টিলার। সাবেক পৌর মেয়র কফিরুল আলমের ছেলে রাইস মিল ব্যবসায়ী আমির সোহেল কৃষক না হলেও তাঁকে কেনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে পাওয়ার টিলার। একই উপজেলার সেনুয়া গ্রামের ইউপি সদস্য তবির উদ্দিন পাওয়ার টিলার পেয়েই এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। অথচ তিন বছরের মধ্যে এ যন্ত্র হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই।
ওই প্রকল্প চলাকালে মাঠ পর্যায়ে অনিয়ম এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, বগুড়ার ধুনটের কৃষি কর্মকর্তা মুশিদুল হকের বিরুদ্ধে কম্বাইন হারভেস্টারের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য হয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ১০ উপজেলায় সমকাল খবর নিয়ে এ রকম আরও অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। এত অভিযোগের পরও প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শেখ নাজিম উদ্দিনকে দেওয়া হয় আরেকটি নতুন প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রস্তুতের দায়িত্ব। সেই কাজেও তাঁর সঙ্গী ছিলেন উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম শেখ। প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের ডিপিপিতে একটি বঁটির অবিশ্বাস্য দাম নির্ধারণ করে ব্যাপক আলোচনায় আসা শেখ নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগে করা হয় বিভাগীয় মামলা। তবে তাঁর হয়নি কোনো শাস্তি। বর্তমানে তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মানিকগঞ্জ কার্যালয়ে কর্মরত। শফিকুল ইসলাম শেখকে নতুন যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের ডিপিডি করা হয়। দুই প্রকল্প মিলিয়ে ১৪ বছর ধরে এ পদে আছেন তিনি। তারা দু’জনই নতুন প্রকল্পের পরিচালক হতে তদবির চালালেও শেষমেশ প্রকল্প পরিচালক করা হয় ড. বেনজীর আলমকে। প্রকল্প পরিচালক হতে না পেরে দু’জন মিলে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকল্পেও অনিয়মের ধারা
সরকার ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল মেয়াদে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প হাতে নেয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের ১২ ধরনের ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র দেওয়ার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হচ্ছে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। তবে শুরু থেকেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বৃত্তে প্রকল্পটি। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান মো. বেনজীর আলম। এর আগে তিনি যে প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন, সে সময়ও তাঁর বিরুদ্ধে ছিল নানা অনিয়মের অভিযোগ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে পদোন্নতি পেয়ে বেনজীর আলম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হন। এর মাস ছয়েক পর নতুন প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পান তারিক মাহমুদুল ইসলাম। এ প্রকল্পে অভিযোগের তীর ছিল বেনজীর আলমের দিকে। তবে জবাবদিহির আওতায় না এনে উল্টো মহাপরিচালক থেকে অবসরের আগে তাঁকে এ বছর গ্রেড-১ পদমর্যাদা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। মহাপরিচালক থাকাকালে প্রকল্পের অনিয়ম, দুদকে অভিযোগ ও তদন্ত বিষয়ে বেনজীর আলম বলেন, ‘আমার সময়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। কিছু হয়ে থাকলে তা আমার পরে হয়েছে।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আগে যিনি প্রকল্প পরিচালক ছিলেন, এগুলোর বেশির ভাগই তাঁর সময়কার দেওয়া অডিট আপত্তি। তিনি হয়তো এগুলো খেয়াল করেননি। আমি দায়িত্বে আসার পর এগুলো নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।’
সিডার যন্ত্রে নয়ছয়
সমকালের অনুসন্ধানেও বেশ কিছু জেলায় অনিয়মের খোঁজ মিলেছে। প্রতিটি সিডার যন্ত্র কেনায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। বরগুনায় সরকারের দেওয়া একটি সিডার যন্ত্রের বাজারদর ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ৭০ শতাংশ। ফলে ৮৫ হাজার টাকা জমা দিয়েই সিডার যন্ত্র পাওয়ার কথা। এ যন্ত্র কেনায় কৃষকদের জমা দিতে হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। বরগুনা সদর ইউনিয়নের পাজরাভাঙ্গা গ্রামের কৃষক ফরিদ মিয়া বলেন, ‘আমি কৃষি অফিসে ১ লাখ ২৩ হাজার টাকা জমা দিয়ে সিডার যন্ত্র নিয়ে এসেছি। আমাকে টাকা জমা নেওয়ার কোনো স্লিপ অফিস থেকে দেওয়া হয়নি।’ বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে মাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ৭১২টি সিডার যন্ত্র বরাদ্দ হয়। মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, যাদের তালিকায় নাম আছে, তারা পাওয়ার সিডার যন্ত্র নেননি। আবার অনেকে তিন-চারটি পাওয়ার সিডার যন্ত্র পেয়েছেন।
কারা কী বলছেন
শুরু থেকেই প্রকল্পের কারিগরি কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আইয়ুব হোসেন। তিনি বলেন, কোম্পানির যন্ত্রগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। সব যন্ত্রই খুব ভালো মানের ছিল। তবে কৃষকের হাতে ভালো যন্ত্র যাচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের। প্রকল্পের ডিপিডি আলতাফুন্নাহার বলেন, প্রকল্প শুরুর পর দুই বছর করোনার প্রকোপ ছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা মাঠে কাজ করেছি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে ধান কাটা হতো ৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৬ শতাংশে। যন্ত্রের ব্যবহারের কারণে বছরে ২ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের সফলতা কম নয়। বিশেষ করে কয়েক বছরে হাওরে তা দৃশ্যমান। তবে অনিময় না হলে এটির সুফল আরও অনেক প্রান্তিক কৃষক পেতেন।’ কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘প্রকল্পের কারণে দ্রুত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। কৃষকের সাশ্রয় হচ্ছে, ক্ষতি কমছে। মাঠ পর্যায়ে কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা খতিয়ে দেখব।’