প্রারম্ভিক শৈশবে শিশুর ভাষার বিকাশে মাতৃভাষার বিকল্প নেই

প্রথম পাতা » ফিচার » প্রারম্ভিক শৈশবে শিশুর ভাষার বিকাশে মাতৃভাষার বিকল্প নেই


গবেষণায় দেখা গেছে যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশু তার পরিচিত পরিবেশকে সহজে ও স্বচ্ছন্দে বুঝতে পারে।ফাইল ছবি

জন্মের পর শিশুর কান্না হলো তার চারপাশের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ। কান্নার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে শিশু তার উপস্থিতি সবাইকে জানিয়ে দেয়। শিশু মাতৃগর্ভে যখন থেকে শব্দ শুনতে পায়, তখন থেকে তার ভাষার বিকাশ শুরু হয়। মায়ের মুখের ভাষা শোনার মধ্য দিয়েই শিশুর ভাষার বিকাশের যাত্রা। গর্ভাবস্থা থেকেই মা আর মাতৃভাষার সঙ্গে শিশুর নিবিড় ও সুদৃঢ় যোগসূত্র তৈরি হয়। গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভাবস্থার ২৮ থেকে ২৯ সপ্তাহে শিশুর শ্রবণক্ষমতা তৈরি হয়।

৩২ সপ্তাহ থেকে শিশু শব্দের প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীল হয়। এই সময় শিশু মায়ের কণ্ঠস্বর, কথা, সহজ সংগীত এবং চারপাশের সাধারণ শব্দ বুঝতে সক্ষম হয়। এমনকি ৩৪ থেকে ৩৮ সপ্তাহের মধ্যে শিশু কথা ও সংগীতের মধ্যে বিভিন্ন মেজাজ বা আবেগের পার্থক্য বুঝতে পারে। তাই মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর সঙ্গে কথা বলা, গল্প বলা, শিশুকে নাম ধরে ডাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা প্রারম্ভিক শৈশবে শিশুর মাতৃভাষা তথা ভাষার বিকাশে বিশেষ প্রভাব রাখে।

বিভিন্ন দেশের মতো ‘শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের সমন্বিত নীতি ২০১৩’ অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশুর জীবনে ভ্রুণাবস্থা থেকে প্রথম আট বছর সময় পর্যন্ত প্রারম্ভিক শৈশব নামে পরিচিত, যা শিশুর সামগ্রিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মস্তিষ্ক ও স্নায়ুবিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ভ্রুণাবস্থা থেকে প্রথম পাঁচ বছর শিশুর বিকাশের দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

এ সময়ে শিশুর প্রধান চারটি ক্ষেত্রের, যেমন শারীরিক বৃদ্ধি ও পেশি সঞ্চালন, সামাজিক ও আবেগিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ভাষা ও যোগাযোগমূলক বিকাশের মূল ভিত্তি তৈরি হয়। বস্তুত ভাষার বিকাশমূলক দক্ষতা শিশুর অন্যান্য ক্ষেত্রে মৌলিক দক্ষতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভাষার দক্ষতা শিশুকে সমস্যার সমাধান করতে, আবেগ-অনুভূতি, চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে এবং শিশুকে সৃজনশীল হতে সহায়তা করে। শিশুর শৈশবে অর্জিত ভাষার দক্ষতা, বিশেষত মাতৃভাষার সক্ষমতা পরবর্তী পর্যায়ে তার সাক্ষরতা ও শিক্ষাগত সাফল্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

শিশুর ভাষা ও যোগাযোগপ্রক্রিয়া ভ্রুণাবস্থা থেকে শুরু হয়। শিশু জন্মের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কান্না, নড়াচড়া ও কিছু সুনির্দিষ্ট ধ্বনি ব্যবহার করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একটু-আধটু যোগাযোগ করতে শেখে। তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা, অস্বস্তি ইত্যাদি প্রকাশ করে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে শিশু বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ করে। শব্দ করার ক্ষেত্রে সে স্বরধ্বনি যেমন অ…অ…অ…, ও…ও…ও…ইত্যাদি ব্যবহার করে। দুই মাস বয়সের পর থেকে শিশু স্বরধ্বনির সঙ্গে ও ব্যঞ্জনধ্বনি মিলিয়ে একধরনের ধ্বনি উচ্চারণ করে। শিশুর এসব ধ্বনি অনেক সময় যোগাযোগমূলক হয় না; তবু শিশু বলতে থাকে।

কারণ, এ সময় শিশুর মুখের যন্ত্রগুলো কথা বলার জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিতে থাকে। শিশুর পাঁচ থেকে ছয় মাস বয়সে কথা বলার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখা যায়। আগে শিশু যেসব ধ্বনি উচ্চারণ করত, এ সময় সেসব ধ্বনিগুলোকে একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত করে নতুন কিছু ধ্বনি উচ্চারণ করে। যেমন দা, মা, বু, গা ইত্যাদি। আবার কোনো কোনো ধ্বনি সে বারবার উচ্চারণ করে; যেমন বা-বা-বা, মা-মা-মা ইত্যাদি। এ সময় শিশুর ধ্বনির উচ্চারণ তার মাতৃভাষা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

৮ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে শিশু প্রথম শব্দ বলা শুরু করে। সাধারণত মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহৃত শব্দ থেকেই শিশু বলতে শুরু করে। এ সময় সে তার চারপাশের পরিচিত মানুষের নাম, বস্তুর নাম অস্পষ্ট করে হলেও বলতে পারে। শিশুর প্রথম বলা বেশির ভাগ শব্দই নামবাচক, যেমন বল, দাদা, মা ইত্যাদি হয়ে থাকে। একটি শব্দ দিয়ে সে একাধিক বস্তু বুঝিয়ে থাকে।

পরবর্তী সময়, অর্থাৎ ১৮ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে শিশু শব্দের সঙ্গে শব্দ যুক্ত করে কথা বলা শুরু করে। এ সময় তাদের বাক্যগুলো সাধারণত দুই শব্দের বেশি হয়, দীর্ঘ হয় না। তবে এ সময় তারা চমৎকারভাবে সংখ্যা-সম্পর্কিত ধারণা এবং বস্তু ও কাজের মধ্যে সম্পর্ক বোঝাতে পারে, যেমন মা টা টা, বল দাও, বাবা নাই ইত্যাদি। এভাবে পর্যায়ক্রমে শিশু দুই শব্দ, তিন শব্দের মাধ্যমে কথা বলতে ও বড় বাক্য বলতে শেখে।

শিশুর ভাষা শেখার এই প্রক্রিয়ায় প্রথম ক্ষেত্র হচ্ছে পরিবার। নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশ, যথাযথ উদ্দীপনা ও শিশুর সঙ্গে মা-বাবার পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া শিশুকে সহজে ভাষা শিখতে এবং তা প্রয়োগ করতে সহায়তা করে। পৃথিবীতে জন্মের পর থেকেই শিশু মায়ের ভাষার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে।

মায়ের ভাষা তথা মাতৃভাষা শিশুর সঙ্গে পরিবারের বন্ধনকে যেমন দৃঢ় করে; তেমনি শিশুকে জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বস্তুত মাতৃভাষা দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে প্রবহমান রাখে। পারিবারিক পরিবেশে মাতৃভাষার চর্চা শিশুর মনে শৈশব থেকে জাতীয়তা বোধ তৈরিতে ও ব্যক্তিত্ব গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশু তার পরিচিত পরিবেশকে সহজে ও স্বচ্ছন্দে বুঝতে পারে। মাতৃভাষায় শিখন ও এর চর্চা শিশুকে সৃজনশীল হতে এবং তার মধ্যে বিশ্লেষণমূলক চিন্তাদক্ষতা তৈরি করতে সাহায্য করে। মাতৃভাষা শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং শিশুকে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশে সহায়তা করে। তাই শিশুর প্রারম্ভিক শৈশবে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রারম্ভিক শৈশবে শিশুর ভাষার বিকাশের জন্য মা-বাবা, যত্নকারী ও পরিবারের সবার যা করা প্রয়োজন; তা হলো-

- শিশুর শব্দের ভান্ডার বাড়ানোর জন্য বেশি বেশি কথা বলা;
- শিশুর সঙ্গে খেলা করা;
- শিশুর বয়স উপযোগী ছড়া বলা ও গান করা;
- শিশুকে গল্প শোনানো ও তাকে নিজের মতো করে গল্প বলতে উৎসাহিত করা;
- শিশুকে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম, বিভিন্ন বস্তু, পশুপাখি, ছবি বর্ণনা করা;
- শিশুকে প্রশ্ন করা এবং তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া;
- শিশুকে সহজ নির্দেশনা দেওয়া এবং তা অনুসরণ করতে সহায়তা করা;
- শিশুর সঙ্গে গান করা, গল্প ও ছড়া বলার সময়ে শুদ্ধ ও স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলা;
- শিশুকে কথা বলার সুযোগ ও সময় দেওয়া;

শিশুর সঙ্গে নিরাপদ বন্ধন তৈরি করা এবং তার কথা মন দিয়ে শোনা ইত্যাদি।
শিশুর ভাষার দক্ষতা উন্নয়নে মাতৃভাষার কোনো বিকল্প নেই। মাতৃভাষা শিকড়স্বরূপ। শিকড় যেমন মাটির সঙ্গে আঁকড়ে ধরে গাছকে ফুলে-ফলে বিকশিত করে, তেমনি মাতৃভাষা শিক্ষা ও চর্চা শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের যোগসূত্র তৈরি করে। যা প্রকৃতপক্ষে শিশুকে দেশ ও জাতির প্রতি সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হতে এবং দেশপ্রেমিক হতে সহায়তা করে। তাই মাতৃভাষাচর্চার শক্ত ভিত তৈরি হোক শিশুর প্রারম্ভিক শৈশবে।




আর্কাইভ