বাংলার-পৃথিবীঃ আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঋণখেলাপির দায়ে মনোনয়নপত্র বাতিল অধিকাংশই ছোট ঋণগ্রহীতা বা চুনোপুঁটির। ঋণখেলাপির এই জালে কাঙ্ক্ষিত বড় রাঘববোয়ালরা ধরা পড়েনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে সরকার। ছোটরা তো সে সুযোগ পায়নি। সে কারণে তারা খেলাপিমুক্ত হতে পারেনি।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, যেখানে হাজার কোটি টাকার রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে, সেখানে চুনোপুঁটি নিয়ে ব্যস্ত। আসলে তারা তো ব্যাংকের মালিক। তাদের মধ্যে এমন অনেক আছেন-যারা নিজেদের ঋণ নিজেরাই পুনঃতফশিল করেন। যা আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব ছিল। এতে তাদের খেলাপি থেকে বের হওয়া অনেক সহজ হয়েছে। মূলত যে উদ্দেশ্যে আইনটি পাশ হয় অর্থাৎ ঋণখেলাপি হলে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, হাজার কোটি নয়, মাত্র ৮৭ হাজার টাকা খেলাপির দায়ে প্রার্থিতা হারালেন চট্টগ্রাম-৪ আসন থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করা মো. সালাহ উদ্দিন। তিনি একটি সরকারি ব্যাংক থেকে কৃষিঋণ নিয়ে পরে তা খেলাপি হয়ে যান। একই ব্যাংকের ২ লাখ টাকা খেলাপি সিলেট-২ আসন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা ইকবাল হোসেন। ঝিনাইদহ-২ আসনের নজরুল ইসলাম ১ লাখ টাকা খেলাপি (তবে ঋণটি ৩ ডিসেম্বর সমন্বয়ের দাবি করা হয়)। রাজশাহী-৫ আসনের আলতাফ হোসেন মোল্লা ৩ লাখ ২১ হাজার টাকা খেলাপি। তালিকায় থাকা আরও কয়েকজনের খেলাপির অঙ্ক পাঁচ, সাড়ে পাঁচ ও ছয় কোটি টাকা দেখা গেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে সরকার। সে কারণে তারা খেলাপি হয়নি। কিন্তু ছোটরা তো সে সুযোগ পায় না। সে কারণে অথবা তারা ব্যাপারটা জানত না, ঠিকমতো খেয়াল করেনি তাই খেলাপিমুক্ত হতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে ১১৮ জন প্রার্থী খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। এরা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি। নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে এসব প্রার্থীর সিআইবি তথ্য যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশ ব্যাংক এ তথ্য পেয়েছে। নির্বাচনে অংশ নিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ মোট ২৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। বাছাইয়ে বাতিল ৭৩১। এর মধ্যে শুধু ঋণখেলাপির জন্য বাতিল ১১৮।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীদের ঋণের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য নির্বাচন কমিশন অনুরোধ জানিয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রার্থীদের সিআইবি তথ্য যাচাই-বাছাই করে একটি প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছি। প্রতিবেদন তৈরি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা সাপ্তাহিক ছুটির দিনও অফিস করেছেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, এমন সব প্রার্থীর তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে ১১৮ জনকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।
আইন অনুযায়ী, ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। তাই মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে সম্ভাব্য প্রার্থীর দেওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। কোনো প্রার্থী ঋণখেলাপি থাকলে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেন। এ কারণে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে উপস্থিত থাকেন। এছাড়া আপিলের শুনানির সময় নির্বাচন কমিশনেও ঋণখেলাপি প্রার্থী ঠেকাতে ব্যাংক কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন।
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে নবায়ন বা পরিশোধ করতে হয়। আর যথাসময়ে ঋণ নবায়ন হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রার্থী হতে পারেন। অন্যথায় প্রার্থী হতে পারবেন না।
জানা যায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা অংশ নেবেন, তাদের খেলাপি ঋণের তথ্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। গত মঙ্গলবার এফআইডি থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। এই পরিপত্র গত বৃহস্পতিবার দেশের সব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) কাছে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরিপত্রে বলা হয়, প্রার্থীদের ঋণখেলাপি তথ্য রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে দিতে হবে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন বা তার আগেই। প্রার্থীদের ঋণখেলাপি সম্পর্কিত তথ্য নির্ভুলভাবে দেওয়ার দায়িত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের। ভুল তথ্য দিলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত থেকে প্রার্থীদের খেলাপি ঋণের তথ্য মিলিয়ে দেখবেন এবং কোনো ঋণখেলাপি প্রার্থী হয়েছেন কিনা, তা নিশ্চিত হবেন।