বাংলার-পৃথিবীঃ কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, আবার কখনও রোদ। রয়েছে দমকা হাওয়া। জামালপুর শহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে গাড়ি ছুটছে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র তীরের জনপদ চিকাজানীর দিকে। চারপাশে ফসলি জমি। দুপুর গড়াতেই জমে উঠেছে গ্রামের বাজার। ফসল নিয়ে কৃষক ছুটছেন সেই বাজারে। কৃষিপ্রধান এ এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী নদীর জোয়ার-ভাটা। বন্যার সঙ্গে লড়াই করে সোনালি ফসল ফলান কৃষক। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এ ফসল পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। কখনও ঘরে থেকে পোকামাকড়ের আক্রমণে, কখনও ফসল নষ্ট হয় বন্যায়। অসময়ে বিক্রির কারণে পান না পর্যাপ্ত দাম। বলা যায়, পানির দরে বিক্রি করেন।
অবশেষে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে ব্র্যাক। চিকাজানী গ্রামে ‘শস্য গোলা’ নামে বানিয়েছে সংরক্ষণাগার। ঐতিহ্যবাহী ধান-চালের গোলার আদলে বানানো এ কৃষি প্রযুক্তিই এখন কয়েক গ্রামের মানুষের ভরসা হয়ে উঠেছে। এতে দুর্যোগের সময় প্রায় ৪০ টন শস্য সংরক্ষণ করা যাবে, কম দামে ফড়িয়াদের কাছে করতে হবে না বিক্রি। প্রাথমিকভাবে দেওয়ানগঞ্জে শস্য গোলা নির্মাণ করা হলেও পর্যায়ক্রমে আরও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে ব্র্যাকের।
শস্য গোলা পরিচালনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য থেকে ১৩ জনকে নিয়ে করা হয়েছে পরিচালনা কমিটি। ব্র্যাকের অর্থায়নে একজন তত্ত্বাবধায়ক এটি দেখভাল করেন। গত ১৬ জুন থেকে চালু হাওয়া এ গোলায় এখন পর্যন্ত শতাধিক কৃষক বিনামূল্যে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। দিঘিরপাড় গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আব্বাস আলী সাত মণ ধান রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘বন্যাপ্রবণ এলাকার কারণে প্রতিবছরই ফসল নষ্ট হয়। ফসল ওঠানোর পর বস্তা ভরে রাখলে ক্ষতি হয়। এবার আর সে সমস্যা হয়নি। সাত মণ ধান ব্র্যাকের শস্য গোলায় রেখে ১ হাজার ৪৪০ টাকা মণ দরে বিক্রি করেছি।’
কৃষক আবদুল ওহাব বলেন, ‘ধান-ডাল চটের বস্তায় ভর্তি করে এতদিন ঘরে রাখতাম। পোকা কিংবা ইঁদুরের আক্রমণে গড়ে ১০-১৫ শতাংশ শস্য নষ্ট হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডালশস্য। কিন্তু ব্র্যাকের শস্য গোলায় মজুত রাখলে এ সমস্যা হয় না।’
শস্য গোলা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কিষানি ববিতা আক্তার বলেন, ‘সবার ধান রাখার মতো জায়গা গোলায় নেই। ফলে গ্রামবাসী মিলেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, কার শস্য রাখা জরুরি। শস্য গোলা
হওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীর দাপট কমছে। ব্যাপারীরা সরাসরি এসে ব্র্যাকের শস্য গোলা থেকে পণ্য কিনছেন। পরিবহন খরচও লাগছে না। তিন-চার মাস ঘরে ডাল, চালসহ দানাজাতীয় পণ্য সংরক্ষণ করা গেলে দামও বেশি পাওয়া যায়।’
ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক এ কে এম রাইসুল আলম খান বলেন, ‘৫ শতাংশ জমিতে ৩২ লাখ টাকা খরচে শস্য গোলা বানানো হয়েছে। চলছে সৌরশক্তিতে। ফসল ভালো রাখতে সব রকম ব্যবস্থা এখানে আছে।’ ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন ও স্থানীয় দুর্যোগ-ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, ‘বন্যাকবলিত, স্বাভাবিক ও দু-একটি উপকূলীয় এলাকায় শস্য গোলা স্থাপনের চিন্তা করছি। আমরা জামালপুরে একটা করেছি, পটুয়াখালীতে করব দুটি। জামালপুরের দুর্গম এলাকা টিনের চরেও করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দেশে সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়। এ জন্য এ খাতে ব্র্যাকের শস্য গোলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে সরকার। সরকার চাইলে গ্রামে গ্রামে এ কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে শস্যের সুরক্ষা করতে পারে।’