বাংলার-পৃথিবীঃ আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ধার দেওয়ার সুদহার বাড়ানোর পরদিনই ব্যাংকের গ্রাহক পর্যায়ে সুদহারের ঊর্ধ্বসীমাও বাড়ানো হয়েছে। নতুনভাবে বিতরণ করা ঋণে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে ৩ শতাংশের পরিবর্তে এখন সাড়ে ৩ শতাংশ যোগ করা যাবে। কৃষি ও রপ্তানি ঋণে ২ শতাংশের পরিবর্তে আড়াই শতাংশ যোগ করা যাবে। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়।
আইএমএফের ঋণের শর্ত পরিপালনের জন্য গত জুলাই মাসে সুদহার নির্ধারণের নতুন ব্যবস্থা চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যবস্থায় স্মার্ট তথা সিক্স মান্থ মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সঙ্গে একটি করিডোর রয়েছে। প্রতি মাসে স্মার্ট রেট ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেপ্টেম্বর মাসের স্মার্ট রেট দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ। এতে করে অক্টোবর মাসে বিতরণ করা ঋণে সর্বোচ্চ সুদ হবে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত মাসে যা ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ ছিল। কৃষি ও প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণের সুদ আগের মাসের ৯ দশমিক ১৪ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। ঋণের সুদ বৃদ্ধির ফলে আমানতের সুদও বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো হলো।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ার প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে অবশ্যই পড়বে। ব্যবসায়ীরা এমনিতেই বিভিন্ন চাপে রয়েছেন। চাপ আরও বাড়বে। অনেকেই নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়বেন। অবশ্য মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য এ সময়ে সুদহার না বাড়িয়েও উপায় নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বুধবার নীতি সুদহার হিসেবে পরিচিত ‘রেপো রেট’ এক লাফে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। এর আগে এ হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। রেপোর পাশাপাশি স্পেশাল রেপো এবং রিভার্স রেপোর সুদহারও ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে রেপোর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং আন্তঃব্যাংক কলমানি থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধার নেওয়ার ঊর্ধ্বসীমা দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ব্যবস্থাকে বলা হয়, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) ঊর্ধ্বসীমা। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে টাকা রাখা কিংবা অন্য ব্যাংকে ধার দেওয়ার সুদহারের নিম্ন সীমা তথা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সাড়ে ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অগ্রাধিকার। যে কারণে এবারের মুদ্রানীতি সংকোচনমূলক করা হয়েছে। তবে প্রত্যাশিত মাত্রায় মূল্যস্ফীতি কমছে না। এ কারণে বিভিন্ন বিশ্লেষণ করে মুদ্রানীতিকে আরও সংকোচন করার জন্য সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ঋণের খরচ বাড়িয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে আগামীতে যে স্মার্ট রেট আরও বাড়বে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এর সঙ্গে সাড়ে ৩ শতাংশ যোগ করার ফলে পরবর্তী মাসগুলোতে আরও বেশি হার দাঁড়াবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ নীতি সুদহার অনেক বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। তবে বাংলাদেশে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত ৯ শতাংশ সুদের ঊর্ধ্বসীমা ঠিক করা ছিল। আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে নতুন ব্যবস্থা চালু করা হয়। ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে আইএমএফ প্রতিনিধি দল এখন ঢাকা সফর করছে। তারা সুদহার আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
আইএমএফের পরামর্শে ১৯৮৯ সাল থেকে মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। তবে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে শেষ পর্যন্ত তা আর ধরে রাখতে পারেনি। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মেটাতে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চুক্তি করেছে সরকার। এ ঋণের অন্যতম শর্ত দেওয়া হয়, সুদহারের সীমা বেঁধে দেওয়া যাবে না। এর পর গত জুলাই থেকে আগের সীমা তুলে দিয়ে সুদহারের নতুন পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছে। নতুন ব্যবস্থাকে বলা হয়, ‘স্মার্ট’ তথা সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। এই উপায়ে ১৮২ দিন মেয়াদি সরকারি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করে ব্যাংকগুলো। আর সিএমএসএমই এবং ভোক্তা ঋণের ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ সুদ যোগ করা যায়। সেপ্টেম্বরের ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ৭ দশমিক ২০ শতাংশ।