বারবার বিতর্কে ভিসি ফরিদ

প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » বারবার বিতর্কে ভিসি ফরিদ


ফাইল ছবি
বাংলার-পৃথিবীঃ   শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সিলেটে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেকেই তাঁর এ বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বলছেন, একজন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন অভিভাবক কী করে এ কথা বলতে পারেন। গতকাল বৃহস্পতিবার ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয় শাবি ভিসির এমন নসিহত। তবে বারবার বিতর্কে নাম জড়ালেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি। তাঁর পদত্যাগ চেয়ে শিক্ষার্থীরা টানা আন্দোলন করলেও স্বপদে রয়েছেন ‘তালেবানি কালচার নিয়ে গৌরবান্বিত’ এই উপাচার্য।

গত বুধবার তিনি ফের আলোচনায় আসেন শিক্ষার্থীদের কড়া শাসনে রাখার কথা বলে। তিনি বলেন, ‘এখানে ওপেন কালচার ছিল। ছেলেমেয়েরা যা খুশি তাই করতে পারত। কেউ কিছু বলতে পারত না; কারণ তাদের বয়স ১৮ বছর। কিন্তু আমি বলেছি, সাড়ে ১০টার মধ্যে হলে ঢুকতে হবে। তারা এটার নাম দিয়েছেন তালেবানি কালচার। আমি তালেবানি কালচার নিয়ে গৌরবান্বিত, এটা নিয়ে থাকতে চাই।’

এর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন ভিসি ফরিদ, যা ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ভাইরাল হয়। তখন ছড়ানো একটি অডিওতে উপাচার্যকে বলতে শোনা যায়, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের কেউ বউ হিসেবে চায় না এবং এরা সারা রাত ঘোরাফেরা করে।’ যদিও পরে এই মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।

একই বছরের ২২ জুলাই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমদ ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহতের পর ভিসি বলেন, ‘ইদানীং আমাদের ক্যাম্পাসে কোনো শৃঙ্খলা নেই। রাতে দিনে যে যেভাবে পারে সেভাবে অবাধ বিচরণ করছে, যা দেখলে নিজেরাও লজ্জিত বোধ করি।’ অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন।

চার বছর পর দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পান। তাঁর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা ও একগুঁয়েমির অভিযোগ রয়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি রাতে বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী ছাত্রী হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে। পরে উপাচার্যের পক্ষ নিয়ে ছাত্রলীগ হামলা করে।

এরপর অধ্যাপক ফরিদের পদত্যাগ চেয়ে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি থেকে ভিসির বাসভবনের সামনে অনশন শুরু করেন ২৮ শিক্ষার্থী। তাদের ১৯ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে ‘তালেবানি কায়দায়’ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিযোগ তোলেন। সেই থেকে ‘তালবানি কালচার’ শব্দটি আসে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙান বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ভিসি ফরিদের সর্বশেষ বিতর্কিত মন্তব্যের বিষয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবালের নীরবতা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে কয়েকজন শিক্ষক ভিসির পক্ষ নিয়ে মানববন্ধন করেছিলেন। তাদের একজন অধ্যাপক ড. লায়লা আশরাফুন পরবর্তী সময়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হয়েছে। ‘এই ভিসি না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হয়ে যাবে’– মন্তব্য করা শিক্ষক পরবর্তী সময়ে বড় পদে নিয়োগ পান। যদিও প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে চললেও কাজ এগোয়নি।

সুলতানা আকতার লুবনা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, একজন ভিসির বুঝতে হবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ও নিজেদের চিত্তবিনোদনের আয়োজনকে ‘ফ্রি-মিপিং’ আখ্যায়িত করা অজ্ঞদের মতো কথা বলা।

ভিসির ‘তালেবানি শাসন’

ক্যাম্পাসের ভেতরে যাতায়াতে শিক্ষার্থীরা কেবল রিকশা ও অটোরিকশা ব্যবহার করেন। কিন্তু ১১টার পর তা চলে না। শিক্ষার্থীদের ‘চাষাভুসা’ নামের টং দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত বছরের ২০ অক্টোবর বেগম সিরাজুন্নেছা চৌধুরী হলের এক ছাত্রীকে কক্ষে আটকে সাজানো স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয় বলে ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ জোবেদা কনক খানের বিরুদ্ধে। উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

ছাত্রদের কেউ ভিসির সমালোচনা করলে ছাত্রলীগ দিয়ে হুমকি দেওয়া এবং মারধর করার অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশ না মেনে ভিসি ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালাচ্ছেন রেজিস্ট্রার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, কলেজ পরিদর্শক, গ্রন্থাগারিক ও হিসাব পরিচালকের দপ্তর।
শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপ মন্তব্য করলেও ছাত্রলীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিতরা ভিসির পক্ষে লিখছেন ফেসবুকে।

শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক ড. চন্দ্রানী নাগ বলেন, শুধু উপাচার্য নন, শিক্ষকরা কী বলবেন আর বলবেন না, তা নির্ধারণ করা সমিতির কাজ নয়। সমিতির অন্য নেতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ভিসির মন্তব্যের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
‘তালেবানি কালচার’ এবং সমালোচকদের হেনস্তার বিষয়ে ভিসি ফরিদের বক্তব্য বৃহস্পতিবার সারাদিন চেষ্টা করেও জানতে পারেনি। গতকাল তিনি অফিসে গেলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি।

যা বললেন বিশিষ্টজন

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত  বলেন, শাবি ভিসির এমন বক্তব্যে আমরা মর্মাহত। তিনি সিলেটে তথা দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠের প্রধান হয়ে তালেবান শব্দ কিংবা তাদের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে উদাহরণ দিতে পারেন না। কারণ, তালেবান শব্দটির সঙ্গে জঙ্গিবাদ জড়িত।

শিক্ষাবিদ সালেহ আহমদ বলেন, উপাচার্য শিক্ষার্থীদের শাসন কিংবা তাদের ভালোর জন্য অনেক উদ্যোগ নিতে পারেন। তালেবান শব্দ ব্যবহার করে তিনি কেন উদাহরণ দেবেন? মুক্তচিন্তার অধিকারী হলো শিক্ষার্থীরা, তাদের বেঁধে রাখা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য তাঁর দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয় না। তাঁর এই বক্তব্য দুঃখজনক। এতে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। এমনিতেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তার ওপর এ ধরনের মন্তব্য করলে আরও ক্ষুণ্ন হয়।

গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আলমগীর শাবি ক্যাম্পাসের ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। উপাচার্যের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গতকাল রাতে তিনি বলেন, উপাচার্য কেন তালেবানি কালচারকে সমর্থন করার কথা বলেছেন, সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। আপনারা আমাকে নয়, তাঁকেই জিজ্ঞেস করুন। আমি এ নিয়ে কিছু বলতে চাই না।

আপনি কি তাঁর বক্তব্যের বিরোধিতায় কিছু বলেছিলেন– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমি কিছু বলব না। তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা তিনিই দেবেন, আমি নই।




আর্কাইভ