বাংলার-পৃথিবীঃ বিলুপ্ত নদী ও নৌপথ পুনরুদ্ধার কার্যক্রম গতিশীল করতে পারছে না বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের আওতায় খনন ও পলি অপসারণের মাধ্যমে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথে নাব্য ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা থাকলেও ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিলুপ্ত নৌপথ পুনরুদ্ধার হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার। নদী খননে বিআইডব্লিউটিএর এই ধীরগতির কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে বিলুপ্ত নৌপথ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বড় বড় নদী মেগা প্রকল্পগুলোর আওতায় আনা হলেও খনন ও ড্রেজিং কাজ চলছে অপরিকল্পিতভাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে রাষ্ট্রীয় তহবিলের টাকা ব্যয় হচ্ছে; কিন্তু জনগণ সুফল পাচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ২০০৯ সালে দেশের ৫৩টি নৌপথ খননের মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪টি নৌপথের ১০ হাজার কিলোমিটার সচল করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল।
সূত্র জানায় মেগা প্রকল্পের আওতায় গত বছর পর্যন্ত সাত হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল করা হয়েছে বলে বিআইডব্লিউটিএ থেকে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু এই পরিমাণ নৌপথ সচল হয়েছে কাগজে-কলমে। কারণ ৩ হাজার ৮০০ কিলোমিটার নৌপথ আগেই সচল ছিল। এদিকে যথাযথভাবে খনন ও পলি অপসারণ না করায় অনেক নৌপথ পরিত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে। সরকার পর্যাপ্ত অর্থ
ব্যয় করলেও অপরিকল্পিত খনন ও পলি অপসারণের কারণে নাব্য উন্নয়নে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এক্সক্যাভেটর ও ড্রেজার স্বল্পতার কারণে নদী খনন ও ড্রেজিং কাজ আগে ব্যাহত হলেও এখন সে সংকট নেই। গত ১৪ বছরে বিআইডব্লিউটিএর বহরে সহায়ক জলযানসহ ৩৮টি নতুন ড্রেজার যুক্ত হয়েছে। সংস্থাটির বহরে এখন ড্রেজারের সংখ্যা ৪৫। এ ছাড়া বেসরকারি কোম্পানিগুলোর অর্ধশতাধিক ড্রেজারও নদী খনন কাজে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু নৌপথ পুনরুদ্ধারে যে কাজ হয়েছে তা হতাশাজনক।
২০২০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, নদনদীর নাব্য রক্ষায় ড্রেজিংয়ের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে ১৭৮টি নদী পুনর্খনন করে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথের নাব্য ফিরিয়ে আনা হবে। ২০১৯ সালের ২৫ মে নেত্রকোনায় ভোগাই-কংস নদের খননকাজ উদ্বোধনকালেও প্রতিমন্ত্রী একই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন।
এর আগে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে কালিপ্রসাদ ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে ভৈরব-কটিয়াদী নৌপথের ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের উদ্বোধন শেষে সুধী সমাবেশে তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, সরকার সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নৌপথ খননের উদ্যোগ নিয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছাইদুর রহমান স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উন্নয়ন ও সংরক্ষণ খাতের আওতায় ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে মাত্র ৮০০ কিলোমিটার নৌপথের নাব্য উন্নয়ন করা হয়েছে। একই সংস্থার নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বর্ষা মৌসুমে ছয় হাজার কিলোমিটার ও শুকনো মৌসুমে ৪ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার নৌপথে নৌযান চলাচল করেছে। এই বিভাগের ২০১৭ সালের আরেক চিঠিতে বলা হয়, সরকারের বিশেষ দৃষ্টির কারণে নৌপথের দৈর্ঘ্য ৫৪৭ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। উল্লিখিত পরিসংখ্যানগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথম ছয় বছরে নৌপথ পুনরুদ্ধারে তেমন কোনো সাফল্যই ছিল না বিআইডব্লিউটিএর। এ ছাড়া দুই বিভাগের দুই রকম তথ্যে নৌপথ পুনরুদ্ধারে সংস্থাটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও বলছে, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে ছয় বছরে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হয়েছে। অর্থাৎ গত সাড়ে ১২ বছরে উদ্ধার বা খনন হয়েছে মোট ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটার। তবে নৌপথের অনেক স্থানে প্রয়োজনীয় খনন ও পলি অপসারণ করা হয়নি। কোনো কোনো স্থানে নামমাত্র খনন করা হয়েছে। তাই গত সাড়ে ছয় বছরে খনন করা ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার নৌপথের সবগুলোতে নৌযান চলাচল করতে পারছে না।
এ ছাড়া ২০১৭ সালের আগের ছয় বছরে যে ৮০০ কিলোমিটার নৌপথ খনন করে নাব্য উন্নয়ন করা হয়েছিল, সেগুলোর কয়েকটি ইতোমধ্যে নৌযান চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। নদী খননে বিআইডব্লিউটিএর এই ধীরগতির কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে বিলুপ্ত নৌপথ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
লঞ্চ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদল সমকালকে বলেন, নদী খনন ও ড্রেজিং কাগজে-কলমে হচ্ছে। বাস্তবে নৌপথগুলো পুনরুদ্ধার হচ্ছে না। এ ছাড়া গত এক দশকে ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার অনেক নৌরুট পরিত্যক্ত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য ড্রেজিং কার্যক্রমে লঞ্চ মালিক ও সাংবাদিকদের একজন করে প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছিলেন তারা। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ তা আমলে নেয়নি।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক পরিবেশবিদ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, নদী খননের কিছু মেগা প্রকল্প জনস্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও অনেক নদী খনন করা হচ্ছে। আবার কোনো প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা। এ ক্ষেত্রে সেটাও করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, নদী খনন ও পলি অপসারণের বর্তমান পদ্ধতিতে অনেক ত্রুটি রয়েছে। বড় বড় নদী ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক নৌপথ মেগা প্রকল্পগুলোর আওতায় আনা হলেও খনন ও ড্রেজিং কাজ চলছে অপরিকল্পিতভাবে। এতে রাষ্ট্রীয় তহবিলের টাকা ব্যয় হচ্ছে; কিন্তু জনগণ সুফল পাচ্ছে না।
তবে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদারের দাবি, নদী খনন কার্যক্রম সঠিকভাবেই হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে এই কার্যক্রমে প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার নৌপথ পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, তৃতীয় পক্ষের হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ অনুযায়ী খনন বা ড্রেজিং শুরু করা হয়। কাজ শেষে বিআইডব্লিউটিএ নৌপথগুলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করে।