বাংলার-পৃথিবীঃ রাজধানীর যানজট কমানোর আশায় খুলছে দেশের প্রথম উড়াল মহাসড়ক তথা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। শনিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সড়কের বিমানবন্দর-ফার্মগেট অংশ উদ্বোধন করবেন। রোববার সকাল ৬টা থেকে শুরু হবে যান চলাচল।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফলক উন্মোচনের পর কাওলার র্যাম্পে টোল দিয়ে সরকারপ্রধানের গাড়িবহর ফার্মগেট আসবে। এর পর প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা নগরের পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন।
শুক্রবার সুধী সমাবেশস্থল পরিদর্শন শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, উড়াল মহাসড়কের একাংশ চালুতে রাজধানীর যানজট কিছুটা হলেও কমে আসবে।
‘সাপোর্ট টু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ প্রকল্পসহ সব মিলিয়ে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে উড়াল মহাসড়ক নির্মাণে। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে থেকে রেললাইনের ওপর এবং পাশ দিয়ে বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, মালিবাগ, কমলাপুর হয়ে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। এতে গাড়ি ওঠানামায় থাকছে ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র্যাম্প।
চালু হতে যাওয়া বিমানবন্দর-ফার্মগেট অংশের দৈর্ঘ্য সাড়ে ১১ কিলোমিটার। এ অংশের ১৫টি র্যাম্পের ১৩টি খুলছে, যার দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার। নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ সেতু বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার এবং র্যাম্পে ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার গতিতে যান চলতে পারবে। ফলে ১২ মিনিটে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পৌঁছাবে গাড়ি। বর্তমানে কর্মদিবসে একই পথে ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। যানজটের কবলে পড়লে লাগে কয়েক ঘণ্টা।
সেতু বিভাগ গণবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এক্সপ্রেসওয়েতে পথচারী এবং দুই ও তিন চাকার যান চলতে পারবে না। গাড়ি থামানো যাবে না। যাবে না গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলাও। এক যুগের অপেক্ষা যানজটের শহর ঢাকার এক প্রান্ত থেকে বিনা বাধায় অপর প্রান্তে যেতে ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চুক্তি হয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) তিন বছরে নির্মাণ সম্পন্নের পরিকল্পনা ছিল দেশের প্রথম উড়াল মহাসড়ক এবং পিপিপিরও এটি প্রথম প্রকল্প। তবে বেসরকারি বিনিয়োগকারী অর্থায়ন নিশ্চিত করতে না পারায়, জমি ও নকশা জটিলতায় বারবার পিছিয়েছে নির্মাণকাজ। এক্সপ্রেসওয়ের বাকি আট কিলোমিটারের নির্মাণ আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ করার সরকারি ঘোষণা রয়েছে।
শুক্রবার সরেজমিন দেখা গেছে, উদ্বোধন অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর যে র্যাম্প দিয়ে উঠবে, সেখানে বসেছে কড়া পাহারা। এক্সপ্রেসওয়ের নিচের এলাকা পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। অন্যান্য র্যাম্পও সাজানো হয়েছে উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সাজে।
প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিমানবন্দর থেকে বনানী, বনানী থেকে মগবাজার এবং মগবাজার থেকে কুতুবখালী– এ তিন ধাপে উড়াল মহাসড়ক নির্মিত হচ্ছে। আজ খুলতে যাচ্ছে দ্বিতীয় ধাপের অর্ধেক পর্যন্ত। প্রকল্প প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। তবে খুলতে যাওয়া অংশের কাজ এগিয়েছে ৯৮ শতাংশ। সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন বলেছেন, শুরুতে নানা জটিলতা থাকলেও উড়াল মহাসড়কের বাকি অংশের নির্মাণ নিয়ে আর অনিশ্চয়তা নেই।
নানা বাধা-বিপত্তি
উড়াল মহাসড়কের অর্ধেক চালু হলেও রয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি। অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে উড়াল সড়কের ‘সংঘর্ষ’ লেগেই রয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) যতটুকু জমি দিয়েছে, তাতে মহাখালীর র্যাম্পে ওজন ব্রিজ স্থাপনে জটিলতা রয়েছে। মেট্রোরেলের এমআরটি-৫ (দক্ষিণ) লাইনের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইনমেন্ট সাংঘর্ষিক। হাতিরঝিলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে রাজউকের আপত্তি থাকলেও মিটেছে সরকারপ্রধানের নির্দেশনায়। যদিও হাতিরঝিলের পানিতে এক্সপ্রেসওয়ের ৪১টি খুঁটি নির্মাণ করতে হচ্ছে।
উড়াল মহাসড়কের কারওয়ানবাজার রেলগেট থেকে পলাশীমুখী র্যাম্পের জন্য পান্থকুঞ্জের জমি দিতে আপত্তি রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। জমি দিতে আপত্তি ছিল রেলওয়ের। উত্তর সিটি করপোরেশনের ভাষ্য, উড়াল মহাসড়কের র্যাম্পের কারণে বনানী ও ফার্মগেটে যানজট বাড়বে।
টোল লাগবে চলাচলে
যানবাহনকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। শ্রেণি-১ এ কার, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি), মাইক্রোবাস এবং হালকা ট্রাকের জন্য ৮০ টাকা টোল লাগবে। শ্রেণি-২ এ মাঝারি ট্রাকে (ছয় চাকা পর্যন্ত) ৩২০; শ্রেণি-৩ এ বড় ট্রাকে (ছয় চাকার বেশি) ৪০০ এবং শ্রেণি-৪ এ বাসের জন্য টোল ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
পুরো উড়াল মহাসড়ক চালুর পর শ্রেণি-১ এর যানবাহনকে ১২৫ টাকা টোল দিতে হবে। আংশিক ব্যবহারে লাগবে ১০০ টাকা। শ্রেণি-২ এর যানবাহনের জন্য আংশিক ব্যবহারে ৪০০ এবং পুরো ব্যবহারে ৫০০; শ্রেণি-৩ এর আংশিক ব্যবহারে ৫০০ এবং পুরো ব্যবহারে ৬২৫ টাকা দিতে হবে। শ্রেণি-৪ এর আংশিক ব্যবহারে ২০০ ও পুরো পথ চললে ২৫০ টাকা টোল দিতে হবে।
২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিনিয়োগকারী ইটালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের (ইটাল-থাই) সঙ্গে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায় সংশোধিত চুক্তি করে সেতু বিভাগ। চীনের দুই ব্যাংক থেকে ৮৬১ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ইটাল-থাই ৬ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) বাবদ সরকার দিচ্ছে ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। উড়াল মহাসড়কের জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও নানা কেনাকাটায় ‘সাপোর্ট টু এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নামে আরেক প্রকল্পে সরকার খরচ করছে ৪ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যয় ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।
মূল ঠিকাদারের দায়িত্বে ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড। এতে ইটাল-থাই ৫১ শতাংশ, চীনা শেয়ডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল গ্রুপ ৩৪ শতাংশ এবং আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন ১৫ শতাংশ অংশীদার। প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফায় বাড়িয়ে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংশোধিত চুক্তি অনুযায়ী, ২০২০ সালের শুরু থেকে পরের ২১ বছর উড়াল মহাসড়ক থেকে টোল আদায় করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ২ বছর ৮ মাস চলে গেলেও ঠিকাদার চায় চালুর পর ২১ বছর টোল আদায় করতে। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিমানবন্দরের কাওলা থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত উড়াল সড়কে দিনে ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশে দৈনিক সাড়ে ১৩ হাজার যানবাহন চলবে। সেতু সচিব জানিয়েছেন, কত সংখ্যক যান চলবে, তা ঠিকাদারকে আপাতত গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে না।
চুক্তি অনুযায়ী, পুরো পথ চালুর পর টানা ১৫ দিন গড়ে ১৫ হাজারের কম যানবাহন চলাচল করলে ঠিকাদার ২১ বছরের সঙ্গে বাড়তি আরও ১৫ দিন টোল আদায় করবে। প্রকল্প পরিচালক এএইচএমএস আকতার বলেছেন, যান চলাচলের পূর্বাভাস পুরোনো। চালু হতে যাওয়া সাড়ে ১১ কিলোমিটার উড়াল মহাসড়কের কারণে নিচের রাস্তায় যানজট কমবে; এটিই সফলতা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেছেন, এক্সপ্রেসওয়ের পুরোটা চালু না হওয়ায় খুব বেশি সংখ্যক বাস উঠবে না। তুলনামূলক ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি চলবে। ফলে সাধারণ মানুষ কতটা সুফল পাবে, তা নিশ্চিত নয়।
যানজটমুক্ত চলাচলের সম্ভাবনা
ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের মানুষ পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের সুফল পাচ্ছে। ঢাকার যানজট পরিস্থিতির সমাধান হয়তো আজকেই পাওয়া যাবে না। তবে কিছুটা তো পাওয়া যাবে। মেট্রোরেলের সব ক’টি লাইন এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি চালু হলে ঢাকা আরও আধুনিক শহরের রূপ নেবে।
বিমানবন্দরের কাওলা এলাকায় যেখান থেকে উড়াল মহাসড়ক শুরু হয়েছে, সেখানে যুক্ত হবে নির্মাণাধীন ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এ উড়াল মহাসড়ক সাভার ইপিজেড থেকে শুরু হয়ে আশুলিয়া-বাইপাইল-রাজধানীর আবদুল্লাহপুর হয়ে আসবে। দুই উড়াল মহাসড়কের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৪৪ কিলোমিটার। র্যাম্পসহ দৈর্ঘ্য হবে ৮২ কিলোমিটার। ফলে ভবিষ্যতে সাভার ইপিজেড থেকে বিনা বাধায় কুতুবখালী পর্যন্ত যানবাহন যেতে পারবে। সাভার, গাজীপুর শিল্প এলাকার রপ্তানি পণ্য ঢাকা শহরের যানজটে না আটকে সরাসরি যাবে চট্টগ্রাম বন্দরে।