বাংলার-পৃথিবীঃ বিমানবন্দরে দুটি র্যাম্পের একটি নামার, আরেকটি ওঠার
একাংশের র্যাম্প ফার্মগেট তেজগাঁও কলেজের সামনে গিয়ে নামবে
বিপুলসংখ্যক যান সুবিধার বাইরে রেখে যানজট নিরসন সম্ভব নয় : বলছেন বিশেষজ্ঞরা
অমিতোষ পাল
আর মাত্র এক দিন। রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেলের পর খুলে দেওয়া হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আগামী শনিবার এ প্রকল্পের উদ্বোধন হবে। প্রথম ধাপে চালু হচ্ছে প্রকল্পের বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশ। এ খবরে যানজটের যন্ত্রণায় খাবি খাওয়া নগরবাসীর মনে মিলেছে অনেকটাই স্বস্তি। তবে এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে যানবাহনগুলো দ্রুত আরেক প্রান্তে গিয়ে নামায় যানজট তৈরি হতে পারে, এমন শঙ্কাও আছে।
বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পৌঁছাতে কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে গরমে নাস্তানাবুদ হতে হয় নগরবাসীকে। এখন মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছানো যাবে। এককথায় এই উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আরেকটি গতির ছোঁয়া লাগবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্প উদ্বোধন করবেন।
২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকল্পের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে সেতু কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের পরই নগরবাসী নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের এ প্রকল্পের আওতায় শুরু হয় বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ের কাজ। ৩১টি র্যাম্পসহ এটির মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।
ইতোমধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের। এ অংশে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠানামার জন্য রয়েছে ১৫টি র্যাম্প। প্রথম ধাপে ১৩টি র্যাম্প খুলে দেওয়া হবে। সেগুলো দিয়ে যানবাহন ওঠানামা করতে পারবে।
যে পয়েন্ট দিয়ে ওঠানামা করা যাবে
বিমানবন্দরে থাকা দুটি র্যাম্পের মধ্যে একটি দিয়ে নামা ও আরেকটি দিয়ে ওঠা যাবে এক্সপ্রেসওয়েতে। কুড়িলে ওঠানামার জন্য রয়েছে তিনটি র্যাম্প। এগুলোও প্রথম দিন থেকে উন্মুক্ত থাকবে। মহাখালীর দুটি র্যাম্পের মধ্যে একটি দিয়ে মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে নামা যাবে। আরেকটি ওঠার র্যাম্প চালু হবে কিছুদিন পর। এ ছাড়া বিজয় সরণি ফ্লাইওভার থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার জন্য থাকা দুটি র্যাম্পও উন্মুক্ত থাকবে শুরুতেই। সর্বশেষ র্যাম্পটি ফার্মগেটে তেজগাঁও কলেজের সামনে গিয়ে নামবে। এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে যানবাহন চলতে পারবে। তবে প্রথম ধাপে গতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। ১০ মিনিটেই পুরোটা পথ পাড়ি দেওয়া যাবে।
এক্সপ্রেসওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, আগামী বছর জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে। তখন বিমানবন্দর থেকে উঠে গাড়ি সোজা কুতুবখালী গিয়ে নামতে পারবে। একইভাবে কুতুবখালী থেকে বিমানবন্দরে গিয়ে নামতে পারবে। যেসব যানবাহন শহরের ব্যস্ত এলাকার ভেতর দিয়ে এতদিন বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াত করত, পুরো কাজ শেষ হলে সেগুলোকে আর শহরের যানজটে পড়তে হবে না। খুব সহজেই এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাতায়াত করতে পারবে।
কোন গাড়ির কত টোল
প্রাইভেট গাড়ি, ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) ও হালকা ট্রাকের (৩ টনের কম) জন্য টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ভ্যাটসহ ৮০ টাকা। মাঝারি ট্রাকের জন্য (৬ চাকা পর্যন্ত) ৩২০ টাকা। ৬ চাকার বেশি ট্রাক বা ট্রেইলরের জন্য ৪০০ টাকা। আর সব ধরনের বাসের (১৬ সিট বা তার বেশি) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৬০ টাকা। তবে কোনো অযান্ত্রিক যানবাহন, মোটরবাইক, তিন চাকার কোনো যানবাহন বা সিএনজি অটোরিকশা জাতীয় কোনো যানবাহন এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করতে পারবে না। কেউ হেঁটেও এক্সপ্রেসওয়েতে যাতায়াত করতে পারবে না। অবশ্য এ জন্য অনেকটাই অখুশি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী এবং সাধারণ পথচারীরা। তারা বলছেন, রাজধানীতে চলাচলকারী ২০ লাখ যান্ত্রিক যানবাহনের মধ্যে ১০ লাখই মোটরসাইকেল। এ ছাড়া লক্ষাধিক সিএনজি অটোরিকশা রয়েছে। এই বিপুলসংখ্যক যানবাহন এক্সপ্রেসওয়ে সুবিধার বাইরে রাখলে যানজট নিরসনের উদ্দেশ্য অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যেতে পারে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, যানজট নিরসন করতে হলে অফ-পিক ও পিক-আওয়ার হিসাব করে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করতে হয়। অফিসের সময় যানবাহনের যখন খুব চাপ থাকে, তখন অনেক যানবাহনই হয়তো এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে। কিন্তু রাত ১০টার পর যখন রাজপথ ফাঁকা হয়ে যায়, তখন অনেকেই হয়তো নিচ দিয়েই চলাচল করবে। এ জন্য টোলের হার অফ-পিক ও পিক-আওয়ার হিসেবে নির্ধারণ করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। সিএনজি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেলের বিষয়টিও পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া গণপরিবহন বিশেষ করে বাসগুলো নিচ থেকে যাত্রী নেয়। এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে তারা যাত্রী পাবে কোথায়। এ ক্ষেত্রে বাসগুলোর এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারে অনুৎসাহিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
যানজটের নতুন শঙ্কা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের মাধ্যমে যানবাহনগুলো দ্রুত আরেক প্রান্তে গিয়ে নামার ফলে সেখানে যানজট তৈরি হতে পারে। ওইসব পয়েন্টের যানজট নিরসনে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ কাজী সাইফুল নেওয়াজ বলেন, ওইসব পয়েন্টের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে যানজট নিরসনের লক্ষ্য পূরণ হবে না।
এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেডের ৫১ শতাংশ, চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপের ৩৪ শতাংশ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের ১৫ শতাংশ অংশীদারিত্বে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা; যার ২৭ শতাংশ বাংলাদেশ সরকার ভিজিএফ হিসেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে দেবে।