বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ,কানাডায় অঢেল সম্পদ বাচ্চুর, সেখানেই আত্মগোপন?

প্রথম পাতা » জাতীয় » বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ,কানাডায় অঢেল সম্পদ বাচ্চুর, সেখানেই আত্মগোপন?


আব্দুল হাই বাচ্চু

বাংলার পৃথিবীঃ বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির হোতা, ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু এখন কোথায়? তিনি কি দেশে, নাকি পালিয়েছেন?

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির পরও যে বাচ্চুর নাম দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আসামির তালিকায়ই ছিল না, দীর্ঘ ৮ বছর পর সেই বাচ্চুর নাম দুদকের অভিযোগপত্রে আসায় এ নিয়ে বেশ জোরেসোরে আলোচনা চলছে। বাচ্চু কোথায়- তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ৭ জুনের পর গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট বা ঢাকার কোনো বাড়িতেই তাকে দেখা যায়নি। তবে সূত্রটি বলছে, ৭ জুন বাচ্চু কানাডায় পালিয়ে যান। সেখানে তার বাড়িসহ অঢেল সম্পদ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ধারণা, দুদকের চার্জশিটে নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে-এমন খবর পেয়ে দেশ ছেড়েছেন বাচ্চু। তাহলে কি দুদকের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মকর্তারা বাচ্চুকে এ খবর দিলেন? তারাই কি তাকে এত বছর বাঁচিয়ে রেখেছিলেন মামলা থেকে? ঘুরপাক খাচ্ছে এ প্রশ্নগুলোও।

গোয়েন্দাদের আরেকটি সূত্র বলছে, বাচ্চু নিয়মিত সিঙ্গাপুরে যাতায়াত করতেন। কানাডা হয়ে সেখানেও পাড়ি জমাতে পারেন তিনি।

এদিকে দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, বাচ্চুর দেশত্যাগ ঠেকাতে দেশের জল-স্থল ও বিমানবন্দরে চিঠি পাঠানো হয়েছে, যাতে তিনি কোনোভাবেই দেশ ছাড়তে না পারেন।

বাচ্চু কি দেশে রয়েছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে দুদকের কমিশনার জহুরুল হক বলেন, ‘বাচ্চু বিদেশে পালিয়েছেন বলেও কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য-প্রমাণ দুদকের হাতে নেই। সেক্ষেত্রে বাচ্চু দেশে আছেন- এমন ধারণা থেকেই তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার চিঠি পাঠানো হচ্ছে বিমানবন্দরে।’

এ বিষয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানাচ্ছে, দুদকের দায়ের করা ৫৮ মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হচ্ছেন-আগেভাগে এই খবর পেয়ে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। যদিও তার বিদেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু দুদক থেকে নিয়মিত ফলোআপ না করায় তিনি সেই সুযোগ নিয়ে গত ৭ জুন দেশত্যাগ করেন।

সূত্র জানায়, দেশ ছাড়ার আগে বাচ্চু তার বেশ কিছু সম্পদও বিক্রি করে দেন। কিছু সম্পদ দুদক ক্রোক করে রাখলেও সেখানে রিসিভার নিয়োগ না করায় তিনি গোপনে অনেক সম্পদ বিক্রি করার সুযোগ পান। এর মধ্যে বনানীর বাড়ির সব কটি ফ্ল্যাট তিনি বিক্রি করে দেন। তার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের কিছু সম্পদও তিনি বিক্রি করেছেন বলে জানা গেছে। তবে দুদক থেকে তার বাগেরহাটের বাড়িটি তালা মেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে তিনি দেশ থেকে কানাডায় পালিয়েছেন- এমন একটি তথ্য গোয়েন্দা সূত্রে জানতে পেরেছে দুদক। সেখানে তার বাড়ি-গাড়িসহ বিশাল সম্পদ রয়েছে। সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদিকে বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ১০ জন সদস্য ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন বলে দুদক টিম তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু তাদের চার্জশিটভুক্ত না করায় প্রশ্ন উঠেছে।

আব্দুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত হলেও এ বিষয়ে ২০১৫ সালে দুদকের দায়ের করা কোনো মামলায় তার নাম ছিল না। উচ্চ আদালত থেকেও দুদককে বারবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছিল। কেন বেসিক ব্যাংক মামলায় আসামি করার ক্ষেত্রে দুদক ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ নীতি নিয়েছে সেই প্রশ্নও তোলেন আদালত। এরপরও কেটে গেছে ৮ বছর। অর্থাৎ মামলার ৮ বছর পর গত ১২ জুন আব্দুল হাই বাচ্চুসহ ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে ৫৮টি মামলার চার্জশিট দিয়েছে দুদক। যদিও মোট মামলা ছিল ৬১টি। বাকি মামলার চার্জশিটও দেওয়া হবে অচিরেই।

এদিকে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চার্জশিট অনুমোদনের পরই বাচ্চুকে গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা করে দুদক। তার বনানীর বাসভবনেও হানা দেয় দুদক টিম। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে গোয়েন্দা সূত্রে দুদক জানতে পারে, চার্জশিটের আগাম খবর পেয়ে তিনি কানাডা পাড়ি জমান।

আব্দুল হাই বাচ্চু দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কী উদ্যোগ নেওয়া হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার জহিরুল হক বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় দেশের বাইরে থেকে দুর্নীতিবাজ এবং তাদের সম্পদ ফিরিয়ে আনা হয় তার ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাকে ফিরিয়ে আনতে আইনি সমস্যা হলে তার অনুপস্থিতিতেই বিচারকার্য সম্পন্ন হবে।’

প্রসঙ্গত, আব্দুল হাই বাচ্চুর কাজ ছিল সরকারি এই ব্যাংকটি যাতে ঋণ বিতরণ ও আদায়ে কোনো অনিয়ম না করে, ব্যাংকিং নীতি মেনে আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা করে তা তদারকি করা, ব্যাংকটিকে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করে আমানতকারীদের স্বার্থসংরক্ষণ করা। কিন্তু ঘটল তার উল্টোটা। তিনি পুরো ব্যাংকটিকে তার পারিবারিক সম্পদে পরিণত করলেন এবং নজিরবিহীনভাবে লুটপাট আর ঋণ জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়লেন। ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন এ আর্থিক কেলেঙ্কারিতে তোলপাড় ছিল সারা দেশে। বিশেষ করে এত বড় অপরাধ করেও তিনি ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তাকে এড়িয়ে যায়, যা ছিল তীব্রভাবে সমালোচিত। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হন আলোচিত এই ব্যক্তি। তার ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়।

২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তা অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানকালে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন, ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ঋণপত্র যাচাই না করে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। জামানত ছাড়া এবং জাল দলিল মর্টগেজ রেখে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদন করেন তারা।

দীর্ঘ পাঁচ বছর অনুসন্ধান চলাকালে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর কমিশনের অনুমোদন নিয়ে ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে ৫৬টি মামলা দায়ের করা হয়। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় দায়ের করা এসব মামলায় মোট ১২০ জনকে আসামি করা হয়। আসামির তালিকায় ৮২ ঋণগ্রহীতা, ২৭ ব্যাংকার ও ১১ জন ভূমি জরিপকারীর নাম থাকলেও ছিল না ঋণ কেলেঙ্কারির মূল হোতা আব্দুল হাই বাচ্চুর নাম। কিন্তু মামলার তদন্তকালে দুদক জানতে পারে আলোচিত এই ঋণ কেলেঙ্কারির পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু। এ কারণে বাচ্চুসহ আরও বেশ কয়েকজনের নাম চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে।




আর্কাইভ