বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী মাশতুরা (আসল নাম নয়)। কিছু ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে একটি ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে তাঁকে হয়রানি করা হচ্ছে। ছবিগুলো তাঁর নিজের তোলা এবং এই ছবি কখনোই কাউকে দেননি তিনি। দাবি করা টাকা না দেওয়ায় ইনস্টাগ্রামে আপত্তিকর ক্যাপশন দিয়ে ছবিগুলো ছড়িয়ে দেওয়া শুরু হয়। নিরুপায় মাশতুরা যোগাযোগ করেন পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে। এ নিয়ে জিডি করলে প্রযুক্তিগত তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তাঁর এক আত্মীয়ের বন্ধুর নাম।
তদন্তে জানা যায়, কোনো এক কাজে সেই আত্মীয়ের ল্যাপটপে নিজের ই-মেইল লগইন করে তা লগআউট করতে ভুলে যান মাশতুরা। বন্ধুর ল্যাপটপ ব্যবহার করতে গিয়ে অভিযুক্ত পেয়ে যায় মাশতুরার ই-মেইলের অ্যাক্সেস। সংগ্রহ করে রাখে তাঁর ব্যক্তিগত কিছু ছবি। আর তা দিয়েই ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে।
উন্নত প্রযুক্তি, সহজেই ইন্টারনেটের অ্যাক্সেস ও নজরদারির অভাবে দেশে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে অপরাধের ধরনও বদলেছে। সাইবার ক্রাইমের তদন্ত কর্মকর্তারা এ ঘটনাকে ‘সেক্সটরশন’ হিসেবে অভিহিত করে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, এ ধরনের অপরাধ দেশে একটি সাধারণ ধরনে পরিণত হয়েছে। কিছু অপরাধের বা নির্যাতনের তথ্য সামনে এলেও বেশির ভাগই থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে।
এমনই এক পরিস্থিতিতে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব যৌন নিপীড়নবিরোধী দিবস। যদিও আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে দিবসটি হওয়ায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে দেশের কোথাও উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিও নেওয়া হয়নি।
সাইবার অপরাধের শিকার নারীদের অভিযোগ গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিতে কাজ করছে পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন। ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের ফেসবুক পেজে মোট ৫০ হাজার ৩০৪টি মেসেজ, হটলাইন নম্বরে ৭৮ হাজার ২৩৪টি ফোনকল এবং ৮৮৯টি ই-মেইল এসেছে। অনেকেই একাধিক মাধ্যম বা একাধিকবার যোগাযোগ করেছেন। তালিকাভুক্ত সেবাপ্রত্যাশীর সংখ্যা ৫০ হাজার ৩০৪ জন।
সেবাপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৩৪ হাজার ২৪০ জন নারী সাইবার স্পেসে হয়রানি-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করেছেন। তাদের মধ্যে ১২ হাজার ৭৭৯ জনই পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রদান ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মোট ২০ হাজার ৯৫৩ জনের অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৫০৮ জনের অভিযোগ প্রক্রিয়াধীন।
ভুয়া ফেসবুক আইডি, আইডি হ্যাকড, ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইল হ্যারাসমেন্ট, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোসহ বিভিন্ন সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয়। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, ভুক্তভোগীর ছবি, মোবাইল নম্বর, বাসার ঠিকানা, এনআইডি বা যে কোনো পরিচিতি তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (প্রকৃত বা এডিট করে) পোস্ট করে বা কমেন্ট করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে আইনের আশ্রয় নেওয়ার সংখ্যা দিন দিন কমছে। ২০১৮ সালের জরিপে যেখানে অভিযোগকারীর সংখ্যা ছিল ৬১ শতাংশ, ২০২৩ সালে তা কমে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশে নেমেছে। আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রচলিত আইন সম্পর্কে না জানা (২৪ শতাংশ), এরপরই আছে বিষয়টি গোপন রাখার প্রবণতা (২০ শতাংশ) এবং তিন নম্বর কারণ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানির আশঙ্কার কথা জানিয়েছে ১৮ শতাংশ ভুক্তভোগী।
মামলার সংখ্যা কম
সাইবার ট্রাইব্যুনাল, ঢাকার পিপি অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, প্রতি সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত ২ থেকে ৩টি মামলা আসে, যেসব মামলার ভুক্তভোগী নারী। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগ নারী লোকচক্ষুর ভয়ে, কেউবা সংসার ভেঙে যাওয়ার ভয়ে মামলা করে না। আবার কেউ বিষয়টি জানাতেও চায় না। ফলে দিন দিন এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে নারীদেরই সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।